Mithu Mukherjee: শেষ সিনেমাও সুপারহিট, তবু কেন অন্তরালে চলে গেলেন মিঠু মুখার্জী!
বর্তমানে বাংলা সিনেমা দাবি করে সাবালকত্বের। কিন্তু এই দাবির ভিত্তি প্রস্তর বহুদিন আগেই স্থাপন করেছিলেন কোনো প্রযোজক বা পরিচালক অথবা নায়ক নন, এক নায়িকা। সময় ছিল ষাটের দশকের শেষ দিক। ভারতীয় সিনেমা জুড়ে সেই সময় নায়িকারা ঘরের লক্ষ্মী। বাঙালি নায়িকারা নমনীয়, আত্মত্যাগের প্রতিমূর্তি। সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen) মহানায়িকা। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (Sabitri Chatterjee), সুপ্রিয়া দেবী (Supriya Devi), সন্ধ্যা রায় (Sandhya Ray) তুখোড় অভিনেত্রী। বাংলা সিনেমার প্রকৃত স্বর্ণযুগের স্রষ্টা তাঁরাই। সেই সময় বেহালা চৌরাস্তার বিবেকানন্দ নারী মহাবিদ্যালয় নামে একটি অখ্যাত কলেজের সামনে প্রায়ই দেখা যেত কিছু উৎসাহী তরুণ ঘোরা ফেরা। তাদের আগ্রহ ওই কলেজের এক মিষ্টি মুখকে ঘিরে। যদিও তিনি সেই ভাবে কাউকে পাত্তা দেন না। নাম তাঁর মিঠু মুখার্জী (Mithu Mukherjee)। পাত্তা না দিলেও তাঁকে ঘিরে আলোড়ন ভালোই বুঝতে পারতেন মিঠু।
View this post on Instagram
1967 সালে নৃত্যে পারদর্শী মিঠু শ্যামবাজার ভ্রাতৃসঙ্ঘের রজত জয়ন্তী উৎসবে ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে মঞ্চে জনসমক্ষে এলেন। সেই প্রথমবার মঞ্চে অনুষ্ঠান করেন তিনি। বোধ হয় কলেজ জীবন থেকেই মনের কোণে সযত্নে লালিত হয়েছিল নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন। লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো মুখশ্রী নিয়ে অবশ্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি মিঠুকে। 1971 সালে চিত্ত বসু (Chitta Bose) পরিচালিত ফিল্ম ‘শেষ পর্ব’-এর মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় ডেবিউ করেছিলেন মিঠু। ‘শেষ পর্ব’-এর চরিত্রাভিনেত্রী অবলীলায় হয়ে উঠলেন ‘স্বয়ংসিদ্ধা’। তবে তা অনেক পরের কথা। তার আগে বঙ্গতনয়ার লক্ষ্মীমন্ত নায়িকার মিথ ভেঙে ফেলেছেন মিঠু।
View this post on Instagram
তৎকালীন সময় বাংলা সিনেমায় খলনায়িকারাও অতি খোলামেলা পোশাক পরতেন না। কিন্তু 1973 সালে সকলকে চমকে দিলেন মিঠু। ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ অবলম্বনে দীনেন গুপ্ত (Dinen Gupta) নির্মাণ করলেন ‘মর্জিনা আবদাল্লা’। সারা ফিল্ম জুড়ে ‘মর্জিনা’ মিঠুর আবৃত পোশাক। কিন্তু ক্লাইম্যাক্সে হঠাৎই মর্জিনার আবির্ভাব খোলামেলা লাস্যময়তায়। ডিপ নেক চোলি ও উন্মুক্ত নাভির অনেক নিচে লেহেঙ্গা পরা সত্তরের দশকের বাংলা সিনেমার নায়িকা ও দর্শকদের কাছে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল না। উপরন্তু নায়িকার সারা গায়ে ব্রোঞ্জারের ছোঁয়া। ‘হায় হায় প্রাণ যায়’ নৃত্যশৈলীতে আরব্যরজনীর নিষিদ্ধ হাতছানি লহমায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন মিঠু। বাঙালি দর্শকদের নব্বই শতাংশ কিন্তু কোনো বিতর্ক ছাড়াই গ্রহণ করেছিলেন তাঁকে।
‘মর্জিনা আবদাল্লা’ বাংলা সিনেমার এক নম্বর নায়িকার সারিতে এনে ফেলল মিঠুকে। ‘মৌচাক’ ও ‘স্বয়ংসিদ্ধা’-র মাধ্যমে জন্ম হল এক নতুন জুটির, রঞ্জিত মল্লিক (Ranjit Mallick) ও মিঠুর জুটি। দর্শকদের কাছে এই জুটিতে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। বদলাতে শুরু করেছিল বাংলা সিনেমা। মহানায়ক উত্তমকুমার (Uttam Kumar) বুঝতে পারছিলেন, আসতে চলেছে নতুন যুগ। তিনি সমর্থন করেছিলেন মিঠুকে। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ধীরে ধীরে টলিউড হয়ে উঠছে সেই সময়। তবে মিঠুর লড়াই খুব একটা কঠিন ছিল না। কারণ বাংলা সিনেমার প্রভাবশালী প্রযোজকের বাগদত্তা ছিলেন তিনি। তাঁর প্রযোজনায় তৈরি ফিল্মে মিঠুই হতেন নায়িকা।
View this post on Instagram
লড়াই করতে হয়নি বলেই মিঠুর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। সেই ডানায় ভর করেই বলিউডের প্রস্তাব পেয়েই বাংলা ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। উচ্চাকাঙ্খার কারণে এককথায় ভেঙে দিলেন সেই প্রযোজকের সাথে সম্পর্ক। কিন্তু মিঠু বুঝতে পারেননি, বম্বেতে তিনি নায়িকা নন, ‘অপশন’ হয়ে থেকে যাবেন। দুলাল গুহ (Dulal Guha) নির্মিত ফিল্ম ‘খান দোস্ত’-এর মাধ্যমে বলিউডে ডেবিউ করলেও সেই ভাবে মিঠু কারও নজরে এলেন না। ধর্মেন্দ্র (Dharmendra), বিনোদ মেহরা (Vinod Mehra)-দের সাথে পরপর কয়েকটি ফিল্মে অভিনয় করলেও লাভ হল না। প্রায় সব ফিল্মেই তিনি দ্বিতীয় নায়িকা, সত্তরের দশকে যার কোনো গুরুত্ব ছিল না। একসময় বাসু চট্টোপাধ্যায় (Basu Chatterjee) নির্মিত ফিল্ম ছাড়া অন্য কোনো ফিল্মে অভিনয় করতে চাইলেন না মিঠু। কিন্তু গন্ডি ছোট হয়ে এল। কমে গেল কাজ। বম্বে প্রথম থেকেই বঙ্গতনয়াকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। এবার কাজের ক্ষেত্রেও দেখা দিল শূন্যতা। ফিরে এলেন মিঠু।
ততদিনে তাঁর প্রাক্তনের জীবনে এসে গিয়েছেন অন্য নারী। বাংলা সিনেমা মিঠুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রাণচঞ্চল মহুয়া রায়চৌধুরী (Mohua Roychowdhury) রাজত্ব কায়েম হয়ে গিয়েছে টলিউডে। রঞ্জিত মল্লিকের অভিনয় পরিণত। নবাগত নন, তিনি ভার্সেটাইল। মিঠু বুঝতে পারলেন, হারিয়ে যাওয়ার পথে তিনি। তবু শেষ চেষ্টা করেছিলেন।
View this post on Instagram
1990 সালে মিঠুর প্রযোজনায় তৈরি হল বাংলা ফিল্ম ‘আশ্রিতা’। পরিচালনা করলেন চন্দ্র বারোত (Chandra Barot)। সেই সময় মিঠুর সাথে বম্বের পরিচালক চন্দ্রর নতুন প্রেম। সুপারহিট হল ‘আশ্রিতা’। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের পরিবর্তে অন্তর্হিত হলেন মিঠু। বোধ হয় মেনে নিতে পারছিলেন না হারিয়ে যাওয়া রাজত্বের অবশেষ,বম্বের মাটিতে অসফলতা। চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল আত্মবিশ্বাস। কোথাও ঘিরে ধরেছিল হেরে যাওয়ার কষ্ট। যুঝতে পারলেন না মিঠু। জিতে গিয়েও হার মানা হারকে বরণ করে নিলেন তিনি। আবারও বম্বে পাড়ি দিলেন মিঠু। নায়িকা হিসাবে নয়, চন্দ্র বারোতের বিবাহিতা স্ত্রী হিসাবে।
#FaceOfTheWeek #DevenVerma with Mithu Mukherjee in #BasuChatterjee’s Safed Jhooth (1977). He played the quirky character of Sulaiman, a room caretaker/waiter of circuit-house. The film was a #remake of Salil Sen’s #Bengali film Chhutir Phande (1975). pic.twitter.com/RpPVvPhqzm
— NFAI (@NFAIOfficial) May 23, 2022
শোনা যায়, যখন মিঠু অন্তরালে চলে যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। মুম্বইয়ের বুকে সংসার পেতেছেন মিঠু। টলিউডের অন্দরে শোনা যেত, মিঠু নাকি সেখানে নাচের স্কুল তৈরি করেছেন। কিন্তু তা আদৌ সত্য না গুজব, কোনোদিনই কেউ যাচাই করেননি। বর্তমানে মিঠু কখনও সখনও কলকাতায় আসেন। বিভিন্ন পদ রান্না করে পরিবারের সদস্যদের খাওয়াতে ভালোবাসেন তিনি। কিন্তু মিডিয়ার স্পটলাইট পছন্দ করেন না একসময়ের এই নামী অভিনেত্রী।
মিঠু বয়সে অনেক সিনিয়র, অভিজ্ঞ একজন মানুষ। কিন্তু তিনি উদাহরণও বটে। প্রভাবশালী প্রযোজক প্রেমিক ছিলেন তাঁর ভরকেন্দ্র যাঁকে আশ্রয় করে বাংলা সিনেমায় মিঠুর একের পর এক ফিল্মে অভিনয়, স্টারডম। লড়াই করে স্থান তৈরি করতে হয়নি বলেই গড়ে ওঠেনি আত্মবিশ্বাস। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মিঠু এখানেই করেছিলেন যা তাঁর প্রতিভাকে ঠেলে দিল অন্তরালে। মিঠুর ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, শর্টকাট নয়, হার্ডওয়ার্ক সফলতার অন্যতম সিঁড়ি।