“আমার গোলা রইল। ওকে দেখিস।” এক মায়ের শেষ ইচ্ছা, শেষ আর্তনাদ বয়ে এসেছিলো দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত নার্সিং হোমের আট তলায় ৭২২ নম্বর ঘর থেকে। ২২ জুলাই, সম্ভবত বর্ষার সময়। একদিকে বৃষ্টি অন্যদিকে মায়ের চোখের বৃষ্টি। সেদিন বাংলা চলচিত্র জগতও ভিজেছিল। শরীরের ৯০ শতাংশ ঝলসে যাওয়া অভিনেত্রী টানা ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেন, অবশেষে অবসান হয় একটা গোটা অধ্যায়ের। মাত্র ২৬ অথবা ২৭ এর মধ্যে জীবনের ইতি টানেন তিনি।
অনেকে বলেন মহুয়ার মদ্যপানে আসক্তি ছিল। এমনকি তাঁর বাবা নীলাঞ্জন রায় চৌধুরী মহুয়ার মৃত্যু তদন্তের সময় বলেছিলেন যে তাঁর মেয়ে মদ্যপান করতেন। এখানেই শেষ নয়, মহুয়ার প্রিয় বান্ধবী রত্না ঘোষালের কথা থেকেও উঠে আসে এমন কিছু তথ্য যা থেকে এটা স্পষ্ট যে মহয়া দুর্ঘটনার দিন মদ্যপ ছিলেন এবং প্রায় সময় মদ্যপান করতেন। অভিনেত্রী রত্না ঘোষালের কথায় দমদমের বাড়িতে গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিল আগেও মহুয়া। এমনকি অভিনেতা স্বামী তিলক চক্রবর্তীর সঙ্গে ঝগড়া হলে, ক্ষুর দিতে হাত কেটে তাঁর কাছে আসতেন মহুয়া।
মহুয়ার সহঅভিনেত্রী দেবশ্রী রায় যখন ‘দাদার কীর্তি’ করছিলেন তখন থেকেই মহুয়ার মধ্যে একটা চাপা কষ্ট তিনি অনুভব করতেন। পরবর্তীতে দেবশ্রী তা বলেওছেন। একদিকে প্রিয় বান্ধবী রত্না ঘোষালের দাবী মহুয়ার মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা আছে এবং সেদিন ওটা নিছক আত্মহত্যা, কোন খুন নয়। অন্যদিকে কিংবদন্তী অভিনেত্রী মাধবীর বিশ্বাস, মহুয়ার পরিবারের মধ্যে ছিল গোপন শত্রু। মাধবীর প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী আত্মহত্যা হলে গায়ে আগুন লাগাবে সামনে দিয়ে, পিছন দিয়ে লাগাবে না।
রত্না ঘোষালের কথায় মদ্যপানের পর নাকি মহুয়া অমানুষ হয়ে যেতেন। তবে কি নিজেই নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছিলেন মহুয়া? নাকি তাঁর গায়ে সেদিন কী কেরোসিন ঢেলে পিছন থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়? কোনটা? উত্তর আজও অধরা।
অভিনেত্রী রত্না ঘোষালের কথায় এও জানা গিয়েছে যে মহুয়া বাংলাদেশে গিয়ে নিজের কেরিয়ারকে অন্যরকম করে সাজাতে চাইতেন। যেদিন গায়ে আগুন লাগে মহুয়ার ঠিক তার পরের দিন বাংলাদেশের চিঠিটা এসে যায়, কিন্তু মহুয়া তখন বাঁচার জন্য লড়াই করছেন। বাংলাদেশের অভিনেত্রী হওয়া তার আর হয়নি।
‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এ ঘোড়সওয়ার হয়ে মহুয়া এসেছিলেন। তারপরেই এই মেয়ে জয় করে বহু পুরুষ হৃদয়। এক ঢাল কালো লম্বা চুল, পান পাতার মত মুখ, পটল চেরা চোখ সবমিলিয়ে অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন মহুয়া। ভালোবেসে খুব কম বয়সে বিয়ে করেন বাল্যবন্ধু, ব্যাঙ্কে কর্মরত কিশোরকণ্ঠী তিলক চক্রবর্তীর সাথে। বেপরোয়া প্রেম জমে ওঠে দুরন্ত অভিজ্ঞতায়। বিয়ের পরপর তিলক-মহুয়ার জীবনে আসে তমাল। ডাক নাম ছিল ‘গোলা’। ফুটবল অসম্ভব পছন্দ করতেন মহুয়া, সেই থেকেই ছেলের নাম রাখেন গোলা।
মহুয়ার কেরিয়ার জীবনের ছন্দ ফেরে যখন ‘দাদার কীর্তি’ করেন ১৯৮০ তে। এর আগেও বহু সিনেমা করেছিলেন, কিন্তু দাদার কীর্তি তাঁকে বিশেষ পরিচিত দেয়। সহজ সরল মুখ বহু হৃদয় জয় করে নেয়। এরপরেও কিসের দুঃখ মহুয়ার? কেন মদ্যপান করতেন? কেন বেপরোয়া জীবন বেছে নিয়েছিলেন? যার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের অভিনেত্রী হওয়ার সে কিকরে গায়ে আগুন দেয়?
ছেলেকে ভালবাসতেন মহুয়া। তাই তো মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চলাকালীন বান্ধবী রত্না ঘোষালকে বলেছিলেন “আমার গোলা রইল। ওকে দেখিস।” দুর্ঘটনার দিন নাকি অভিনেত্রী মদ্যপ ছিলেন এবং মদ্যপ অবস্থায় ছেলের জন্য স্টোভে দুধ গরম করছিলেন। আপনারা হয়তো জানেন এল পি জি গ্যাস সিলিন্ডার ১৯৬৫ তেই চলে আসে। সেই সময়ের পর থেকে কিছু সংখ্যক মানুষ গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে নিয়েছেন। একজন অভিনেত্রী তাঁর বাড়িতে স্টোভ থাকলেও কি গ্যাসের কোন সুবিধা ছিল না? সংশয় রয়ে গেল। বাড়িতে পরিচারিকা থাকা স্বত্বেও তিনি কেন মদ্যপ অবস্থায় ছেলের জন্য দুধ গরম করতে গেলেন? পুলিশ তদন্ত করে জানিয়েছিলেন সেই সময় যে মহুয়ার বাড়ি থেকে একটি অক্ষত স্টোভ উদ্ধার করা গিয়েছে। এবং তাতে সামান্য কেরোসিন তেল ছিল। তবে কি সেই স্টোভের কেরোসিন কেউ তাঁর গায়ে ঢেলে দিয়েছেন? পুলিশের তদন্তে এও উঠে এসেছিলো যে অভিনেত্রী মহুয়ার পিঠে এবং শরীরের আরও কয়েক জায়গায় কালশিটের দাগ পাওয়া যায়। যার সদুত্তর মেলে নি। এমনকি মহুয়ার মুখের ডান দিকে একটা ক্ষতচিহ্নের দেখা মেলে, যার উত্তরে মহুয়ার বাবা বলেছিলেন যে কাপড়ের টুকরো আটকে যায় দুর্ঘটনার সময়, সেই টুকরো টেনে তুলতে গেলে মহুয়া ব্লেড দিয়ে কেটে নিতে বলে আর তাতেই নাকি এই বিপত্তি।
সেদিন মহুয়ার রান্নাঘর অক্ষত ছিল। অথচ তাঁর শোবার ঘরের বিছানা বালিশ তোষক পুড়ে গিয়েছিল। মহুয়ার স্বামী অক্ষত ছিলেন শুধু পায়ে সামান্য চোট পেয়েছিলেন, অন্যদিকে মহুয়ার বাবার তিনটি আঙুলের ডগায় সামান্য চোট ছিল। সেদিন পরিবারের তরফ থেকে কোনও এফআইআর করা হয়নি। রত্না ঘোষালের কাছে রাতে ফোন আসে মহুয়ার স্বামী তিলকের থেকে। যাইহোক, মহুয়ার অকালে চলে যাওয়ার পর এমন গুঞ্জন আসে যে এই তদন্ত চলার কিছুদিনের মধ্যে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধের নির্দেশ আসে! কাহিনীর এখানেই শেষ নয়, তিলক এবং নীলাঞ্জনের সাথে মহুয়ার যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল। সেই যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো মহুয়ার মৃত্যুর ঠিক চার দিন আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে কি এটি সত্যি আত্মহত্যা? নাকি খুন? নাকি একজন মদ্যপ মানুষকে পরোক্ষ ভাবে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া? কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে তা বুঝি মৃত্যুর ওপারে গিয়ে জানা সম্ভব নয়।
আর তাইতো কেন মহুয়ার মৃত্যু রহস্যের কোন কিনারা হল না তা আজও অধরা। শিপ্রা রায় চৌধুরী থেকে মহয়া হয়ে ওঠার পথ খুব মসৃণ না থাকলেও নিজের দাপটে, অভিনয় গুণে, সৌন্দর্যের নিরিখে অনেক চলচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ২৭ বছর বয়সের মধ্যে চলে যান, তাও দিয়ে গেছেন ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘সাহেব’, ‘আদমি অর অউরাত’, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’, ‘তিল থেকে তাল’, ‘অভিমান’, ‘সপ্তমুখী’, ‘আশীর্বাদ’ এর মত বহু বাংলা সিনেমা।
টলিউড হোক বা বলিউড এরকম অকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে আসছে। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী মৃত্যুর কোলে অজ্ঞাত কারণে আশ্রয় নিয়েছেন যা আজও অধরা, অজানা থেকে যাচ্ছে। শুধু রয়ে যাচ্ছে কাহিনীর কাঁটা ছেঁড়া আর প্রশ্ন।