পার্লারের কাজ শিখে স্বনির্ভরের পথে রূপান্তরকামীরা
তথাকথিত সমাজে লিঙ্গ বলতে নারী আর পুরুষ, আজও এমনটাই মনে করেন বহু মানুষ। আর এই দুই প্রজাতির মাঝে প্রচ্ছন্ন থেকে যায় আরো এক সুপ্ত সম্প্রদায়, যাদের নিয়ে চর্চা বা আলোচনা বেশ কিছুদিন আগেও একেবারে হতো না বললেই চলে। এরা কারা বলুনতো বলুন তো? হ্যাঁ মনে মনে ঠিকই ভাবছেন এরা হলেন বৃহল্লনা বা রুপান্তরগামী। কিন্তু কি আশ্চর্য বলুন তো আমাদের সমাজের তথাকথিত ভদ্র মানুষেরা এদের মানুষ বলেই মনে করেন না। কেউ কেউ তো আবার এদের সমাজের আর্বজনা বলে মনে করেন। সাধারণ মানুষের মতো এদেরও হাত আছে, পা আছে, সর্বোপরি একটি সুন্দর মনও আছে। কিন্তু তবু কেন এই বিভেদ বলুন তো! আজও এরা সমাজের বুকে পায়না কোনো পরিচয়। না পায় সঠিক করে শিক্ষার সুযোগ, না পায় কাছের মানুষের ভালোবাসা। সব কিছু থেকে নিজেরা থাকে বঞ্চিত। আজও রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে চোখ পড়লে দেখা যায় কেউ কেউ ভিক্ষে করছে তো কখনো ট্রেনের মধ্যে নাচছে। বর্তমান ভারতের এভাবেই বহু রূপান্তরকামীদের রোজগার করতে হচ্ছে। কিন্তু আর কতদিন বলুন তো?
অনেকেই এদেরকে দেখলে করুণা করে হাতে দু পয়সা দিয়ে চলে যায়। এরাও অন্যদের মতো পড়াশোনা করে নিজেদের পছন্দমতো জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। কিন্তু সঠিক সুযোগ এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে দেওয়া হয়না। এরা সবসময়ই চিরবঞ্চিত। কিন্তু অনেক হয়েছে, আর নয়। আজ এই সম্প্রদায়েরই কিছু মানুষ সাহস করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। জীবনের বহু বাধা বিপত্তি ও চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ভিক্ষা নয় বরং খেটে রোজগার করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখছেন।
বর্তমানে সমাজে মহিলাদের সমান অধিকারের কথা অনেকেই ভাবেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে মেয়েদের নানা কর্মক্ষেত্রের জন্য কুর্নিশ দেওয়া হচ্ছে। এই দীর্ঘ লকডাউনে আজ বহু পুরুষ মহিলার পাশাপাশি বৃহল্লনারা কর্মহীন। সেই কথা মাথায় রেখেই চলতি বছরের ১৬ই ডিসেম্বর দক্ষিণ কলকাতায় ঘটল এক অভিনব ঘটনা। একটি বিখ্যাত মলের ঠিক বিপরীতে ‘মোমাফ স্টাইল জোন’, প্রথম রুপান্তরকামী নারীদের জন্য জীবিকা নির্বাহের জন্য এক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। ‘জীবিকা আস্তানা’ ট্যাগলাইন দিয়ে সেই দিন ১২ জন রুপান্তরগামী মানুষদের বিউটিশিয়ান কোর্স হাতে ধরে শেখানো শুরু হল। কিভাবে ফেসিয়াল, স্কিনের যত্ন, নেল আর্ট প্রতিটি জিনিস সূক্ষ্ম ভাবে শেখালেন বিখ্যাত শিল্পীরা। নিজেদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে নিষ্ঠার সাথে বিনা পয়সায় এই কোর্স শেখানো হল। এই দিন বিউটিশিয়ান কাকলি ব্যানার্জী শেখালেন কিভাবে ফেসিয়াল করতে হয়, ত্বকের যত্ন নিতে হয়। অ্যাথেনা গোস্বামী যত্ন সহকারে শেখালেন হাতের নখের যত্ন নিতে।
এখানেই শেষ নয়, ১৮ই ডিসেম্বর শুক্রবার তানিয়া রায় কিভাবে বেকিং হয় সেই পদ্ধতি শেখালেন হাতে করে। প্রথম দিন এই রূপান্তরগামী ভাই বোনদের উৎসাহিত দিতে উপস্থিত থাকলেন অভিনেত্রী মল্লিকা মজুমদার এবং রুকমা রায়। মল্লিকা মজুমদার বললেন,“মানুষ সকলে এক। লিঙ্গ,ধর্ম এগুলো কোনো আলাদা করে আমি দেখিনা। সবাই ভালো করে কাজ শেখো, কাজ শিখে প্রতিষ্ঠিত হও।” অন্যদিকে অভিনেত্রী রুকমা রায় এই ভাই বোনেদের শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়ে বললেন, “তোমরা ভালো করে নেল আর্ট শেখো। কিছুদিন পর তোমাদের থেকে আমি নেল আর্ট করবো… আমিও সাজবো”।
এই দুদিন ধরে এই ট্রান্স পুরুষ মহিলাদের জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন, “অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার হিজরাস অফ বেঙ্গল”-এর প্রধান রঞ্জিতা সিনহা।পার্লারের কর্ণধার মুন সাহা জানালেন,”সেদিন যাদের কাজ শেখানো হচ্ছে, মন দিয়ে কাজ শিখতে পারলে এরা পরবর্তী কালে অনেক পার্লারে কাজ পাবেন। তার আগে মন দিয়ে কাজ শিখতে হবে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।” ১৬ ও ১৮ই ডিসেম্বর মুন সাহা নিজের পার্লার পুরোপুরি বন্ধ রেখে এই লকডাউনের পর ব্যবসায়ে এত ঘাটতির পর এই মানুষদের জন্য রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করলেন। এদের মধ্যে একজন ছাত্রী সৃষ্টি দাস জানালেন,”আমি এখানে ভালো করে কাজ শিখতে এসেছি। কাজ শিখে আমি ভালো কাজ করতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যেতে চাই।” এখানকার ১২ জন শিক্ষার্থী জীবনে অনেক বাধা পেরিয়ে এই পার্লারে কাজ শেখার সুযোগ পেয়েছেন ও এই শেখার জেরে আগ্রহের সাথে রুপচর্চার জীবিকাকে বেছে নিতে পেরে বেশ আনন্দিত সকলে।