2018 সালের 24 শে ফেব্রুয়ারি। সমগ্র পৃথিবী আলোড়িত হল, শ্রীদেবী (Sridevi) নেই। কোথাও নেই তিনি। চিৎকার করে ডাকলেও আসবেন না আর। সব কলঙ্ক, সব আশা-অপবাদ মাথায় নিয়ে দুবাইয়ের বিলাসবহুল হোটেলের বাথটাবের জলের নিচে নিশ্চিন্তে তলিয়ে গিয়েছেন তিনি। রহস্যে আবৃত ছিল না জীবন। ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার। কিন্তু শ্রীদেবী কি নিজে সত্যিই সুপারস্টার হতে চেয়েছিলেন?
View this post on Instagram
1963 সালের তামিলনাড়ু, পুরুষতান্ত্রিকতা যার পরতে পরতে। ফিল্ম, রাজনীতি সবকিছুই তখন পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে। দ্রাবিড় সভ্যতায় তখন মেয়েরা শুধুই শো-পিস। দক্ষিণ ভারতের তথাকথিত মধ্যযুগীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত মিনামপাত্তি গ্রামে জন্ম হল শ্রীআম্মা (Shree Amna yanger Ayappan)-এর। সেদিন কেউ বলেনি, লক্ষ্মী এসেছে। কন্যাসন্তানের জন্ম আইনজীবি পিতার মুখ গম্ভীর করেছিল। মা রাজ্যেশ্বরী (Rajyeswari)-র চারপাশ যেন থমথমে। কন্যাসন্তান মানেই তার বিয়ের জন্য একরাশ যৌতুক। তাকে মুখে নুন দিয়ে মেরে না ফেললেও শৈশব ছিনিয়ে নিলেন মা-বাবা। স্কুলে শিক্ষার জন্য শ্রীআম্মার বরাদ্দ রইল না একটি পয়সাও। মাত্র চার বছর বয়সী শিশুকন্যা তার মা-বাবার কাছে হয়ে উঠেছিল অর্থ রোজগারের মেশিন। 1967 সালে তামিল ফিল্ম ‘কন্ধন করুনাই’-এর মাধ্যমে শ্রীআম্মা প্রবেশ করল অভিনয় জগতে। পৃথিবীটা ঠিক করে চেনার আগেই তার কান্না চাপা পড়ে গেল অর্থের নিচে, স্পটলাইটের আড়ালে। না, ফিল্মে অভিনয় করতে যেতে চাইত না শ্রীআম্মা। সে খেলতে চাইত, পড়াশোনা করতে চাইত। অপর ভাই-বোনদের দেখত শৈশব কাটাতে। সেই সময় কাজ করে ক্লান্ত হয়ে গেলেও ঘুমানোর অনুমতি পেত না শ্রীআম্মা। তার মা-বাবার কাছে সে যে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। একের পর এক ফিল্ম, ছুটি নেই। এভাবেই কখন কেটে গেল মেয়েবেলা।
View this post on Instagram
প্রকৃতির নিয়মে শ্রীআম্মার শরীরে এল যৌবন। কিন্তু তার পাশাপাশি শুরু হল বডি শেমিং। বলিউডেও তখন কয়েকটি ফিল্মে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু সবাই বলতে শুরু করল তাঁর নাক নিয়ে, ঠোঁট নিয়ে, শারীরিক গঠন নিয়ে। তিনি ভাবলেন, এই অজুহাতে এবার মুক্তি পাবেন কর্মজীবন থেকে। কিন্তু বিধি বাম। মায়ের জোরাজুরির ফলে করাতে হল প্লাস্টিক সার্জারি। কারণ ততদিনে জন্ম হয়ে গিয়েছে শ্রীদেবীর। 1979 সালে ‘ষোলয়া সাওন’-এর মাধ্যমে হয়ে গিয়েছিল নায়িকা হিসাবে বলিউড ডেবিউ। সফল হয়নি সেই ফিল্ম। কিন্তু এর চার বছর পর জিতেন্দ্র (Jeetendra)-র বিপরীতে নায়িকা হিসাবে ‘হিম্মতওয়ালা’। চূড়ান্ত বাণিজ্যিক সফলতা পেল সেই ফিল্ম। বলিউডে শুরু হল শ্রীদেবী-যুগ।
View this post on Instagram
কিন্তু অপরদিকে শ্রীদেবীর জীবনে তখন আবির্ভাব হয়েছে কমল হাসান (Kamal Hasan)-এর। দুজনে প্রায়ই একসঙ্গে সময় কাটাতেন। রাজ্যেশ্বরীর কানে গেল সেই কথা। কঠোর হাতে শ্রীদেবী ও কমলের ভালোবাসার বিনাশ ঘটালেন তিনি। কারণ শ্রীদেবীর বিয়ে হয়ে গেলে ঘরে অর্থ আসা বন্ধ হয়ে যাবে, থাকবে না বিলাসবহুল লাইফস্টাইল। আতঙ্কিত হলেন রাজ্যেশ্বরী। একের পর এক হিট ফিল্ম উপহার দিলেও নিজের উপার্জিত অর্থের উপর অধিকার ছিল না শ্রীদেবীর। তাঁদের এক আত্মীয়ের কাছে সমস্ত অর্থ গচ্ছিত রাখতেন রাজ্যেশ্বরী। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই আত্মীয় সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করলে আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হন শ্রীদেবী ও তাঁর পরিবার। একই সময় শ্রীদেবীর বোন পালিয়ে বিয়ে করলে শ্রীদেবীর স্টারডমে তার প্রভাব পড়ে।
View this post on Instagram
অত্যন্ত খারাপ সময়েও শ্রীদেবীর উজ্জ্বলতা বুঝতে দেয়নি তাঁর ভিতরের কষ্টকে। এরপরেই তাঁর জীবনে মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun Chakraborty)-র আবির্ভাব। সেই সময় মিঠুন নিজেও বিবাহিত জীবনে সুখী নন। একদা রাখি বেঁধেছিলেন শ্রীদেবী। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই মিঠুনকেই জীবনসঙ্গী করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার আঘাতে শ্রীদেবী যখন জর্জরিত, সেই সুযোগটাই নিলেন বনি কাপুর (Boni Kapoor)। শ্রীদেবীর জন্য আক্ষরিক অর্থেই সব কিছু করতে পারতেন তিনি। তাঁর প্রযোজনায় ফিল্মে অভিনয় করছেন শ্রীদেবী। তাঁকে এক ঝলক দেখতে বনি পাড়ি দিলেন সুইজারল্যান্ড। ক্রমশ বিবাহিত বনি জড়িয়ে পড়লেন শ্রীদেবীর সঙ্গে। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেন শ্রীদেবী। রাজ্যেশ্বরীর শত অনুরোধেও এবার তিনি রাজি নন পিছিয়ে যেতে। সন্তানের মা হতে চান তিনি, সংসার করতে চান। প্রথমে বনিও মানতে চাইলেন না। বাধ্য হয়ে বনির মা-বাবা ও স্ত্রী মোনা (Mona Kapoor)-এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন শ্রীদেবী। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। অপমানিত শ্রীদেবী তখন শুধু নায়িকা নন, একজন মা। সন্তানের পিতৃপরিচয়ের জন্য লড়াই করলেন বনির সাথে। হার মানতে বাধ্য হলেন বনি। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল মোনার সঙ্গে। অর্জুন (Arjun Kapoor) ও অংশুলা কাপুর (Angsula Kapoor) থাকতে শুরু করলেন তাঁদের মা মোনার সাথে। অপরদিকে হঠাৎই প্রয়াত হলেন রাজ্যেশ্বরী।
View this post on Instagram
কিন্তু এবার কিছুই আটকাতে পারল না শ্রীদেবীকে। মায়ের মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় বিয়ে করলেন বনিকে। শুনতে হল অনেক অপবাদ। কিন্তু এবার শ্রীদেবী ব্যবহৃত হতে চাননি, নিজের জন্যও লড়াই করেননি। শুধু চেয়েছিলেন সন্তানের বৈধতা। একরাশ কলঙ্ক মাথায় নিয়ে এই লড়াই জিতলেন তিনি। জন্ম হল জাহ্নবী (Janhavi Kapoor)-র। সন্তান ও সংসার সামলাতে ফিল্ম জগৎ থেকে সরে গেলেন শ্রীদেবী।
View this post on Instagram
ফিরে এসেছিলেন ‘ইংলিশ ভিংলিশ’-এর মাধ্যমে। ‘মম’ -এও আবারও শ্রীদেবী ম্যাজিক। অপরদিকে ইন্ডাস্ট্রিতে আসার জন্য তৈরি করলেন জাহ্নবীকে। কিন্তু দেখা হল না মেয়ের ডেবিউ ফিল্ম। দুবাইয়ে আত্মীয়র বিয়েতে গিয়েছিলেন। বনি ও কনিষ্ঠ কন্যা খুশি (Khushi Kapoor) মুম্বই ফিরে এলেও নিজের আর্ট এগজিবিশনের জন্য দুবাইয়ে থেকে গিয়েছিলেন শ্রীদেবী। খুব ভালো ছবি আঁকার হাত ছিল। সোনম (Sonam Kapoor)-এর একটি ছবি এঁকেছিলেন তিনি। সেই ছবিটির এগজিবিশন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় বইল অন্য খাতে। স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে আবারও দুবাই পৌঁছে গিয়েছিলেন বনি। বারবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙা হল।
View this post on Instagram
আম্বানি পরিবারের সহায়তায় দেশে ফিরলেন শ্রীদেবী। শেষবারের মতো সাজলেন লাল শাড়ি, টেম্পল জুয়েলারিতে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সম্পন্ন হল। জ্বলে উঠল চিতা। জাহ্নবী ও খুশিকে তখন সামলাচ্ছেন অর্জুন ও অংশুলা। চারজনেই মাতৃহীন। মৃত্যুর মধ্য দিয়েও শ্রীদেবী মিলিয়ে দিয়ে গেলেন পরিবারকে, নাকি শ্রীআম্মা? নায়িকা নয়, সে যে মা হতে চেয়েছিল!
View this post on Instagram