বিতাড়িত হয়েছিলেন একাধিক নামী স্কুল থেকে, বর্তমানে সগর্বে ছাত্র পড়াচ্ছেন দৃষ্টিহীন শিক্ষক
একসময় কলকাতার ২৯ টি নামিদামি স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন দৃষ্টিহীন সায়ন্তন। করোনার আবহে সমস্ত স্কুল-কলেজ যখন বন্ধ তখন এই রকম পরিস্থিতি সামলাতে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। তৈরি করে ফেলেছেন নিজের অনলাইন রেডিও প্ল্যাটফর্ম রেডিও লাউঞ্জ। কসবার সায়ন্তন ব্যানার্জীর স্বপ্ন দেখছেন কিভাবে কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, লাহোর থেকে লন্ডন এ রেডিওর মাধ্যমে বাংলা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিককে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দৃষ্টিহীন হওয়ার জন্য একসময় কলকাতার তাবড় তাবড় স্কুল থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
রুবি পার্ক এর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সায়ন্তন। জন্মের পর থেকেই তার লড়াই চলতে থাকে। ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছিল তিনি আর বাঁচবেন না। কিন্তু ছেলেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন তার বাবা-মা। অবশেষে ছেলের শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও সে সারা জীবনের মতো দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। অতটুকু বয়স থেকেই চলতে থাকে সায়ন্তনের অনন্ত সংগ্রাম। বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। সেই ছেলেই আজ শিক্ষক। সাধারণ বিদ্যালয়ে দৃষ্টিহীনদের পড়ানো হয় না, তাই অগত্যা টালিগঞ্জ লাইট হাউস ফর দ্য ব্লাইন্ড স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানেই ব্রেইল পদ্ধতি রপ্ত করে ফেলেন সায়ন্তন।
তারপরে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ একাডেমিতে তাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। আর তারপর থেকেই চলতে থাকে পড়াশোনা। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক, কুইজ নানা ধরনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে দেন সায়ন্তন। মাধ্যমিকে বেশ ভালো নাম্বার নিয়ে তিনি পাস করেন। মাধ্যমিকে ভালো নাম্বার থাকা সত্ত্বেও কলকাতার কোনো স্কুলে তিনি ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেয় নি পাঠভবন। সেখানে পড়াশোনা করতে করতে শিক্ষকদের চোখের মনি হয়ে ওঠেন সায়ন্তন।
তারপরই বহু বাধা বিপত্তি কাটিয়ে অবশেষে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। সমাজে চলার পথে বাধা বিপত্তিকে জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেন। মন খারাপ এবং একাকীত্বকে কাটাতে তিনি সঙ্গী করে নিয়েছিলেন তার রেডিওকে। দুর্গা পুজো পরিক্রমা তিনি রেডিওর মাধ্যমে শুনতেন। তার পছন্দের মানুষ রেডিও মিরচির আর.জে দীপ। তার এক সাহেব নামে বন্ধু অনলাইন রেডিও প্ল্যাটফর্ম খুলেছিলেন। তিনিও একজন দৃষ্টিহীন মানুষ ছিলেন। কিছুটা তার উদ্দীপনা আর নিজের সুপ্ত ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়েই সায়ন্তন ও একটি অনলাইন লাইভ রেডিও প্ল্যাটফর্ম খুলে ফেললেন।
কলকাতায় প্রচুর মানুষ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক এ কাজ করছেন। তাদের উদ্দেশ্যেই তার এই পরিকল্পনা। সামনে পুজো তাই রেডিও লাউঞ্জে খুব শিগগির আসতে চলেছে ‘পুজোর বৈঠক’ নামে একটা অনুষ্ঠান। যেখানে ঠাঁই পাবে কলকাতার নতুন চারজন ট্যালেন্ট। পেশা এবং নেশা পুরোটাই একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু কোনোটাতেই তিনি খামতি দেননি । দুটোই একেবারে ব্যালেন্স করে তিনি দিব্যি জীবনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষকতা করা তার পেশা কিন্তু এই বিষয়টিকেও তিনি একেবারে শেষ হয়ে যেতে দেননি। শিল্পীসত্তাকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার দরুন অনলাইনে গুগল মিটে ক্লাস করাচ্ছেন এই শিক্ষক। আর অন্যদিকে তার স্বপ্নকে একটু একটু করে সার দিয়ে যত্ন করে লালন-পালন করছেন। আজকে এই শিক্ষক দিবসের দিনে এমন একজন শিক্ষককে স্যালুট জানাতে হয়।