মাতৃদিবস প্রতিটি দেশে পালিত হলেও মনে হয় মাতৃদিবস বলে আলাদা করে সত্যিই কিছু হয় না। কথায় বলে, ভগবান এই পৃথিবীতে নিজে আসতে পারেন না বলেই মাকে পাঠিয়ে দেন। সন্তানের বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি থাকে মায়ের অবদান। গর্ভধারণের সময় থেকে আমৃত্যু মা আগলে রাখেন তাঁর সন্তানদের। বলিউডও তার ব্যতিক্রম নয়। বলিউড তারকা হয়েও নিজের স্টারডম বিসর্জন দিয়ে বহু অভিনেত্রী গড়ে তুলেছেন তাঁদের সন্তানদের।
ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার শ্রীদেবী (sreedevi) প্রযোজক বনি কাপূর (Boni kapoor)-এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ফলে বিয়ের আগেই তাঁর গর্ভে এসেছিলেন জাহ্নবী কাপুর (Janhavi kapoor)। বনিও প্রথম এই সন্তানকে মানতে চাননি। কিন্তু নাছোড় শ্রীদেবী বনির বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর সন্তানের অধিকারের জন্য। বনির বাবা-মা গর্ভবতী শ্রীদেবীকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনার জেরেই বনিকে ডিভোর্স দেন তাঁর স্ত্রী মোনা কাপুর (mona kapoor)। এরপর শ্রীদেবীর সঙ্গে বনির বিয়ে হলেও জাহ্নবী তাঁদের বিয়ের আগে গর্ভে এসেছিলেন বলে শ্রীদেবীকে শুনতে হয়েছে অনেক কুকথা। কিন্তু তবু তিনি আঁকড়ে ধরেছেন তাঁর দুই মেয়ে জাহ্নবী ও খুশি (khushi kapoor)-কে। জাহ্নবীকে ধীরে ধীরে গ্রুম করলেও শ্রীদেবী দেখে যেতে পারেননি জাহ্নবীর প্রথম ফিল্ম ‘ধড়ক’। এই ফিল্ম মুক্তির আগেই দুবাইয়ের হোটেলে বাথটাবের জলে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর।
সোমু মুখার্জী (somu mukherjee)-র সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তনুজা (Tanuja) একাই বড় করে তুলেছিলেন কাজল (Kajol) ও তানিশা (Tanisha)-কে। তনুজা মেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে কাজ না ছাড়লেও তাঁর কাজের সংখ্যা অনেক কমিয়ে দিয়েছিলেন। আজ কাজল সফল অভিনেত্রী। কাজল বহু সাক্ষাৎকারে তাঁর মা তনুজা ও মাসি চতুরা (chatura)-র অবদানের কথা স্বীকার করেছেন।
রাজেশ খান্নাকে বিয়ে করার পর ডিম্পল (Dimple kapadia)-র দুই মেয়ে টুইঙ্কল (Twinkle khanna) ও রিঙ্কি খান্না (Rinki khanna)-র জন্ম হয়। কিন্তু দিনের পর দিন ডিম্পলের উপর রাজেশের অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। একসময় এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুই মেয়ে টুইঙ্কল ও রিঙ্কিকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন ডিম্পল। ডিম্পল একাই দুই মেয়েকে বড় করে তুলেছেন। টুইঙ্কল আজ একজন সফল অভিনেত্রী ও লেখিকা।
অমিতাভ বচ্চন (Amitabh bachchan)-কে বিয়ে করার সময় সুপারস্টার ছিলেন জয়া বচ্চন (Jaya Bachchan)। কিন্তু অমিতাভ ও তাঁর পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য জয়া ধীরে ধীরে তাঁর কাজের সংখ্যা কমিয়ে দেন। এরপর অমিতাভ ও জয়ার দুই সন্তান অভিষেক (Abhishek Bachchan) ও শ্বেতা বচ্চন (sweta bachchan)-এর জন্ম হয়। এইসময় অমিতাভ তাঁর সহ-অভিনেত্রী রেখা (Reekha)-র সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। শোনা যায়, রেখা ও অমিতাভ গোপনে বিয়েও করেছিলেন। কিন্তু জয়া সেই ঝড়ের সামনে দাঁড়িয়েও সন্তানদের মুখ চেয়ে ভেঙে পড়েননি। অমিতাভ জয়ার কাছে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরেও ঘটেছিল অঘটন। ‘কুলি’ ফিল্মের সেটে আহত অমিতাভর অপারেশনের পর প্রাণসংশয় দেখা দিয়েছিল। বৃদ্ধ হরিবংশ রাই বচ্চন (Haribansh Rai Bachchan) ও তেজী বচ্চন (Teji bachchan) সেদিন জয়ার মধ্যে যেন দশভূজা দুর্গাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। জয়ার চেষ্টায় অমিতাভ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। অনেক কঠিন পথ পেরিয়ে অভিষেক আজ একজন সফল অভিনেতা এবং শ্বেতার একটি বুটিক রয়েছে।
অমৃতা সিং (Amrita singh)-এর বিয়ে হয়েছিল সইফ আলি খান (saif Ali khan)-এর সঙ্গে। সৌন্দর্য ও অভিনয়ের দিক থেকে অমৃতা তখন ইন্ডাস্ট্রিতে একঝলক নতুন হাওয়া। কিন্তু কেরিয়ারের শীর্ষে থেকে তিনি বিয়ে করলেন স্ট্রাগলার সইফকে। এই বিয়ে মেনে নেননি শর্মিলা (sharmila tagore) ও টাইগার পতৌদি (tiger pataudi)। কারণ প্রথা ভেঙে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে পতৌদি পরিবারের বৌ হয়েছিলেন অমৃতা। কিন্তু সইফকে ভালোবেসে সইফের কেরিয়ারকে হাইলাইট করার জন্য অন্তরালে চলে যান অমৃতা। জন্ম হয় সারা (sara ali khan) ও ইব্রাহিম (ibrahim ali khan)-এর। একসময় হতাশার ভেঙে পড়া সইফকে আগলে রেখেছিলেন অমৃতা। কিন্তু স্টারডমের সঙ্গে সঙ্গেই সইফ ক্রমশ অমৃতার থেকে দূরে সরে যান। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় সইফ ও অমৃতার। একা সারা ও ইব্রাহিমকে বড় করে তোলেন অমৃতা। সেদিন পতৌদি পরিবারের কেউ একবারের জন্য অমৃতার খোঁজ নেননি। পরবর্তীকালে সারা আলি খান একটি সাক্ষাৎকারে অমৃতার লড়াইয়ের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, একসময় তাঁর মা অনেক কিছু সহ্য করেছেন।
আশির দশক তোলপাড় করলেন কুমারী অবস্থায় মা হয়েছিলেন নীনা গুপ্তা(neena gupta)। ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডস (viv Richards) বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নীনার সঙ্গে সহবাস করেছিলেন। নীনা গর্ভবতী হওয়ার পর ভিভ জানিয়ে দেন, নীনাকে তিনি বিয়ে করতে পারবেন না কারণ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সন্তানদের দায়িত্ব তিনি অবজ্ঞা করতে পারবেন না। নীনা ভিভের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেননি। বলিউড একঘরে করে দিয়েছিল নীনাকে। নিভৃতে নীনা জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর কন্যাসন্তান মাসাবা (Masaba gupta)-র। বহু কুকথা শুনেও হাল না ছেড়ে নীনা বড় করে তুলেছিলেন মাসাবাকে। আজ মাসাবা একজন সফল অভিনেত্রী ও ফ্যাশন ডিজাইনার। ভিভের প্রথমা স্ত্রী মেনে নিয়েছেন মাসাবাকে। তাঁর আমন্ত্রণেই মাসাবা ও নীনা ভিভের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন।
এবার আসা যাক এক বিস্মৃতপ্রায় মায়ের কথায়। তাঁর নাম জদ্দনবাঈ (Jaddanbai)। উত্তর কলকাতার এক খ্যাতনামা বাঈজী জদ্দনবাঈ যেদিন জানতে পারলেন তিনি মা হতে চলেছেন, তখন মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন, কন্যাসন্তান হলে তাঁকে কিছুতেই বাঈজী হতে দেবেন না। একসময় কলকাতার বুকেই ভূমিষ্ঠ হল জদ্দনবাঈ-এর কন্যাসন্তান ফতিমা (Fatima Rashid)। ছোট্ট ফতিমার উপর কোনো অশুভ ছায়া পড়তে দেননি জদ্দনবাঈ। কলেজ স্কোয়ারের সুইমিং পুলের জলে যখন ফতিমা সাঁতার শিখছেন, জদ্দনবাঈ তখন নিঃশব্দে কলকাতা ছাড়ার ব্যবস্থা করছেন। একসময় নিজের প্রেমিক মোহনবাবু (uttamchand mohanchand) ও মেয়ে ফতিমাকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে তৎকালীন বম্বের চেম্বুরে সংসার পাতলেন জদ্দনবাঈ। তৎকালীন নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নাম করতেও শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাদ সাধল তাঁর পরিচয়। কিভাবে যেন রটে গিয়েছিল তিনি এককালে বাঈজী ছিলেন। অন্তরালে চলে গেলেন জদ্দনবাঈ। তাঁর অদম্য জেদ তাঁর মেয়ে ফতিমাকে পরিবর্তিত করল নার্গিসে(Nargis Dutta)। যতদিন জদ্দনবাঈ বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনি আগলে রেখেছিলেন নার্গিসকে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেই নার্গিসের জীবনে আবির্ভাব হয়েছিল রাজ কাপুর (Raj kapoor)-এর।
নার্গিস দত্ত, সমাজের ভয়ে আজীবন যিনি প্রকাশ করতে পারলেন না তাঁর গর্ভজাত মেয়ের পরিচয়। নার্ভাস ও রাজ কাপুরের প্রেমকাহিনী তখন বলিউডের চর্চার শিরোনামে। নার্গিস বারবার রাজকে বলেছিলেন তাঁকে বিয়ে করার জন্য। রাজের প্রথম স্ত্রী কৃষ্ণা রাজ (krishna Raj kapoor)-এর স্থান তিনি চাননি। নার্গিস রাজকে বলেছিলেন, কৃষ্ণার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ না করে তাঁকে দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দিতে। রাজ কিছুতেই রাজি ছিলেন না। রাজের বহুগামিতা নার্গিসের অজানা না থাকলেও তিনি রাজকে বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু সেই বিশ্বাস করাই কাল হল। আর.কে.স্টুডিওয় রাজকে উঠতি নায়িকা পদ্মিনী কোলহাপুরে (padmini kolhapure)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেন নার্গিস। তৎক্ষণাৎ তিনি বেরিয়ে যান স্টুডিও থেকে। ততদিনে নার্গিস জানতে পেরেছেন, তিনি গর্ভবতী। কিন্তু এরপর নার্গিস বিয়ে করতে চাননি রাজকে। বরং রাজ ও নার্গিস সমঝোতা করেছিলেন তাঁদের ব্যবসায়ী বন্ধু চুনিলাল কাপাডিয়া (chunilal kapadia)-র সঙ্গে। ফলে রাজ ও নার্গিসের মেয়ের জন্ম হয় অত্যন্ত গোপনে এবং জন্মের পরেই তাকে তুলে দেওয়া হয় চুনিলাল কাপাডিয়া ও তাঁর স্ত্রীর কোলে। রাজ ও নার্গিসের কন্যাসন্তান সমাজের কাছে পরিচিতি পান চুনিলাল কাপাডিয়ার মেয়ে ডিম্পল কাপাডিয়া (Dimple kapadia) নামে। কিন্তু ডিম্পলের বিয়ের সময় চুনিলালের অনুরোধে রাজ ধরেছিলেন বরের ঘোড়ার রশি। এই প্রথাটি সাধারণত কনের পিতা পালন করেন। ডিম্পলের হাতে প্রথম মেহেন্দির ছোঁয়া দিয়েছিলেন নার্গিস। এটি কনের মায়ের কর্তব্য। হয়তো এইভাবেই আজীবন বঞ্চিত ডিম্পলকে কিছুটা হলেও স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন চুনিলাল কাপাডিয়া।