Hoop Story

দারিদ্রতায় থেমে যায়নি পড়াশোনা, মদ বিক্রি করেই আজ IAS অফিসার রাজেন্দ্র

‘জীবনে চলার পথে কখনো ভেঙে পড়তে নেই। সবসময় সমস্যার কথা চিন্তা করতে নেই। সমস্যা কি করে সমাধান করতে হবে সেই দিকেই এগিয়ে যেতে হবে, তবে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এবং শেষ পর্যন্ত সাফল্যের পথে পৌঁছানো সম্ভব’- এমন অসাধারন কথাটি বললেন মহারাষ্ট্রের নন্দূর্বার জেলার জেলা আধিকারিক ডঃ রাজেন্দ্র ভারুদ। সাক্রি তালুকার সামোদে গ্রামে ১৯৮৮ সালে ৭ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন রাজেন্দ্র বাবু। বান্দু ভারুদ এবং কমলাবাইয়ের পুত্র তিনি। মা যখন গর্ভবতী ছিলেন তখনই তার পিতার অকাল মৃত্যু হয়। তার পিতাকে কেমন দেখতে ছিল রাজেন্দ্র বাবু তা মনে করতে পারেন না।

পিতার মৃত্যুর পর তাদের পরিবার আরো বেশি দারিদ্রতায় ডুবে যায়। দারিদ্রতা কি জিনিস তারা তা জন্মলগ্ন থেকেই টের পায়। মা এবং ঠাকুমা কাজ করে তাদের তিন ভাইকে মানুষ করেন। দেশী মদ বিক্রি করেই তাদের দু মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতেন তার মা। আখ গাছ দিয়ে তৈরি একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে পুরো পরিবারের জীবন চলে যেত। মহারাষ্ট্রের আদিবাসী এলাকাতে প্রচুর পরিমাণে মহুয়া ফুল পাওয়া যায়। আর এনারা মহুয়া ফুলের রস থেকেই দেশী মদ তৈরি করতেন। তবে এই কাজটি মোটেই বেআইনি ছিলনা। মহারাষ্ট্রে এই পানীয় খুবই জনপ্রিয়। অনেক মানুষই তাদের এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে এসে মহুয়া ফুলের এমন পানীয় পান করতেন এবং সাথে খেতেন চাকনা যা এক ধরনের জলখাবার।

অতিথিদের আপ্যায়ন করাই ছিল রাজেন্দ্র বাবুর মায়ের একমাত্র লক্ষ্য। তাই অতিথি আপ্যায়নের সময় যদি কোন বাচ্চা কেঁদে কঁকিয়ে উঠত, মা তখন মহুয়া ফুলের এক চামচ রস খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। ছোটবেলার এমন অভিজ্ঞতার কথাই বললেন রাজেন্দ্র বাবু। এসব কিছু করে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে রোজগার হত। যা দিয়ে তার তিন ভাইবোন মিলে পড়াশোনা এবং থাকা খাওয়া চলে যেত কোনরকমে। স্থানীয় জেলা পরিষদের স্কুলেই তাদের প্রথম হাতেখড়ি। রাজেন্দ্রপুর পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষিকারা অনুভব করলেন তিনি এক অসাধারণ বুদ্ধিমান ছেলে, এই কথাটি তারা তার মাকেও জানান এবং তারা জানান কোনভাবেই যেন পড়াশোনা যেন তার বন্ধ না হয়। বাড়িতে চলছে মদ তৈরি এবং তাতেই চলছে রোজগারের জীবনযাত্রা ঠিক সেই সময় প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে সিবি এস সি বোর্ডের জওহর নবোদয় বিদ্যালয় স্কুল পড়াশোনা করতেন রাজেন্দ্র।

তবে এই সমস্ত বিদ্যালয় ভালো ছেলে- মেয়েরা যারা দূর থেকে আসে তাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা ছিল। অগত্যা তাকে ঘর ছাড়তে হয়। ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মায়ের চোখের জল বাঁধ ভাঙ্গেনি, কিন্তু মা জানতেন এতে তার ছেলের ভালোই হবে। ছুটিতে বাড়িতে এলে মায়ের হাতে হাতে ব্যবসায় সাহায্য করতেন রাজেন্দ্র।

নবোদয় বিদ্যালয় পড়ার সময় থেকেই তিনি অংক এবং বিজ্ঞানে খুবই ভালো ছিলেন। দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় তিনি এই দুই বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ছিলেন। দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষাতে তিনি শ্রেণীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পান। যার ফলে পরবর্তীকালে তিনি স্কলারশিপ মুম্বাইয়ে জি এস মেডিকেল কলেজ ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে তিনি ভাবলেন এমন একটা কাজ করা যায় যাতে সর্বক্ষণ মানুষের পাশে থাকা যেতে পারে। তখন তিনি ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে শুরু করেন। এই কাজটি করা মোটেই সহজ ছিল না প্রতিদিন একেবারে যন্ত্রের মতো তিনি পড়াশোনা করতে শুরু করলেন।

সকাল পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠে প্রাণায়াম, যোগাসন করে ক্লাস করে তারপর আবার নিজের পড়াশোনায় ফিরে আসতেন। আর পাঁচটা ছেলেমেয়েরা যেমন করত তিনি সেই ভাবে মোটেই জীবনযাপন করতেননা, কোথাও বেড়াতে যেতেননা, কোন পার্টিতে যেতেননা শুধুই পড়াশোনাকেই তিনি তার ধ্যান-জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করার জন্য তিনি সমস্ত রকমের পরিশ্রম করেছিলেন। অবশেষে ২০১২ সালে ফরিদাবাদে আই আর এস অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। চাকরি পেয়ে তিনি বসে থাকেননি ইউপিএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার বসে তিনি আই এ এস অফিসার হন। ২০১৭ সালে চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন শোলাপুর। ২০১৮ সালে নন্দূর্বার জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পরেই তিনি এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য নানান ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ৪০ হাজার পরিবারকে রেশনের ব্যবস্থা করে দেন। ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের প্রকল্পের আওতায় তিনি গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, করোনা ভাইরাস এর সময় তিনি তার ব্লকে উচ্চমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করেছে। আজ গোটা ভারতবাসীর কাছে রাজেন্দ্র একজন আদর্শ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে শুধুমাত্র নিজের প্রচেষ্টার দ্বারা মাথা তুলে দাঁড়ানো যায়।

whatsapp logo