Hoop PlusTollywood

Suchitra Sen: কেন অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন?

2014 সালের 17 ই জানুয়ারি কলকাতার বেসরকারি নার্সিংহোম বেলভিউ-এর বুকে ভেঙে পড়েছিল ভিড়। সে ছিল এক মহাযাত্রা। পিছনে ছেড়ে যাওয়া এক সংসার। সদ্য প্রয়াতা মহানায়িকা সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen)-কে একঝলক দেখতে চেয়েছিলেন কলকাতাবাসী। অধিকাংশ মানুষ ভেবেছিলেন, এতদিনের সযত্নে তৈরি অন্তরাল এবার হয়তো ভেঙে যাবে। শেষবারের মতো সকলে দেখতে পাবেন মহানায়িকার মুখশ্রী। কিন্তু তিনি সুচিত্রা সেন, মৃত্যুতেও ভাঙলেন না আড়াল। সাদা বেনারসি পরিহিত, মাথায় ঘোমটা সুচিত্রা নিজেকে আড়ালে রেখেই যাত্রা করলেন মহাসিন্ধুর ওপারে। কিন্তু কেন এই অন্তরাল?

একসময়ের গ্ল‍্যামারাস মহানায়িকা কেনই বা সবকিছু ছেড়ে হঠাৎ আড়ালে চলে গেলেন? সুচিত্রার জীবনের অনেক অজানা কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের সদস্যরাও ভাঙেননি অন্তরালের সিদ্ধান্তের কারণ। তবে সুচিত্রা সেনের কেরিয়ারের শেষের দিক পর্যালোচনা করলে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায় এর কারণ। উত্তম কুমার (Uttam Kumar) ও সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen) অনস্ক্রিন একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। তাঁদের জুটি এতটাই বিখ্যাত ছিল, এখনও অবধি মানুষ প্রেমিক ও প্রেমিকার জুটির উপমা হিসাবে বেছে নেন উত্তম ও সুচিত্রাকে। সুচিত্রা ছাড়াও উত্তম বহু নায়িকার সাথে অভিনয় করলেও সুচিত্রার আগমন তাঁকে সম্পূর্ণ করত। অপরদিকে সুচিত্রা , অন্যান্য নায়কের সাথে হিন্দি ও বাংলা ফিল্মে অভিনয় করলেও উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর জুটি বাঙালিকে মুগ্ধ করত। কিন্তু বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আকাশে হঠাৎই ঘটিয়ে এল কালো মেঘ। মহানায়ক উত্তম কুমারের অকালপ্রয়াণ ঘটল। ভেঙে গেল বাঙালির চিরকালীন উত্তম-সুচিত্রা জুটি। রয়ে গেল একরাশ নস্টালজিয়া। কিন্তু সুচিত্রা ছিলেন পেশাদার অভিনেত্রী। অথচ তাঁর পেশাদারিত্ব পেল না মর্যাদা।

প্রযোজক ও পরিচালকদের একাংশের মনে হল, সুচিত্রা একা মূল্যহীন। অথচ এই নায়িকা তৎকালীন মুম্বইয়ের বুকে রীতিমত তারকা হয়ে উঠেছিলেন। তবুও কলকাতায় ফিরেছিলেন তিনি। সংসারের টানে, কন্যা মুনমুন (Munmun Sen)-এর জন্য। মহানায়িকার পরিচয় ছাপিয়ে সুচিত্রা যে একজন মা। নিজের কেরিয়ারের জন্য কোনোদিন মেয়ের প্রতি অবহেলা করেননি তিনি। কিন্তু তাঁর কন্যা মুনমুন তাঁকে বুঝলেও বুঝলেন না কয়েকজন তথাকথিত প্রতিভাধর পরিচালক ও প্রযোজক। এমনকি বুঝল না সমাজ। আবারও প্রাধান্য পেল পুরুষতন্ত্র।

তথাকথিত সুচিত্রানুরাগীদের মনে হল, উত্তম ছাড়া সুচিত্রা গ্রহণযোগ্য নন। পরমাসুন্দরী সুচিত্রার বয়স ও তাঁর চেহারা নিয়ে কটাক্ষ হল ‘ফরিয়াদ’ ফিল্মের মুক্তির পর। ‘ফরিয়াদ’-এ সুচিত্রার চরিত্রটি ছিল এক মায়ের, যিনি সন্তানকে মানুষ করতে, তাকে পড়াশোনা করাতে অবলীলায় রাতের পর রাত বারে গান গাইতেন। সেই সময় চরিত্রের প্রয়োজনে সুচিত্রা বিশেষ কিছু পোশাক পরলেও, সেগুলি তেমন খোলামেলা ছিল না। কিন্তু মেয়েদের ‘কুড়িতে বুড়ি’ মনে করা সমাজ সুচিত্রার সেরা অভিনয়কে অনুভব করল না। তাঁকে বয়স ও চেহারা নিয়ে অপমানিত করল। মুখ বুজে কিছুদিন সহ্য করেছিলেন সুচিত্রা। ভেবেছিলেন, মানুষ হয়তো ভুল বুঝবে। কিন্তু তিনি জানতেন না, এক নারীকে সঠিক মর্যাদা দিতে শেখেনি সমাজ। ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পেল। অসাধারণ অভিনয় সত্ত্বেও সফল হননি সুচিত্রা। প্রকৃত সত্য হল সফল হতে দেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে সুচিত্রা চলে গেলেন অন্তরালে। তিনি কেমন আছেন, তা জানার প্রয়োজন যেন সকলের কাছে ফুরিয়ে গেল।

কিন্তু হঠাৎই নামী বাংলা সংবাদপত্রে একদিন প্রকাশিত হল ভোটার আইডি কার্ডের জন্য সুচিত্রার ক্যামেরাবন্দী হওয়ার ছবি। বাঙালির নস্টালজিক জেগে উঠল আবারও। মিসেস সেনকে নিয়ে বেড়ে গেল কৌতুহল। মিডিয়া, সাধারণ মানুষ সকলেই এক ঝলক দেখতে চাইলেন তাঁকে। মিডিয়া তাঁর বৃদ্ধাবস্থার ছবি হাতে পেলেও তা প্রকাশ করতে দেননি সুচিত্রা। অনেকে ভাবতেন, সুচিত্রা কি করে গৃহবন্দি থাকতেন! না, তিনি গৃহবন্দি থাকতেন না। নাতনিদের সাথে মাঝে মাঝেই চলে যেতেন ভিক্টোরিয়া। কখনও তিনি যেতেন নিউ মার্কেটে তাঁর কেকের প্রিয় দোকান নাহুম’স-এ। কখনও বা বেলুড় মঠ যেতেন। কিন্তু অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, কেন সেই সময়গুলিতে ক্যামেরাবন্দী হননি সুচিত্রা! প্রকৃতপক্ষে, তাঁকে দেখে অনেকেই চিনতে পারেননি, তিনি সুচিত্রা সেন। বয়সজনিত কারণে চেহারার পরিবর্তন অত্যন্ত স্বাভাবিক। সুচিত্রাও ব্যতিক্রম ছিলেন না।

কিন্তু চেহারার পরিবর্তনের কারণে ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে যাননি সুচিত্রা। এক বুক অভিমান নিয়ে সরে গিয়েছিলেন তিনি। অত্যন্ত চাপা এই মানুষটি নিজের এই অভিমানের কথা কাউকে জানতে দেননি। অযথা চোখের জল ফেলতে পছন্দ করতেন না সুচিত্রা। সবকিছুই নিবেদন করে দিতেন তাঁর ইষ্টদেবতা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, মা সারদামণি ও বিবেকানন্দের চরণে। জীবনের অমূল্য সময় ইন্ডাস্ট্রিকে দিয়েছেন সুচিত্রা। কিন্তু তাঁকে উপলব্ধি করতে চাননি কয়েকজন স্বার্থান্বেষী। সুচিত্রার মতো প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত, সুন্দরী, ব্যক্তিত্ব সম্পন্না মহিলা ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলে ইন্ডাস্ট্রির আবহাওয়া পাল্টে যেতে পারত। নায়ক নয়, শুরু হত নায়িকা যুগ। প্রাধান্য পেত মহিলাতন্ত্র। কাস্টিং কাউচের ঘটনা কমে যেত অনেকটাই। ফলে সেই স্বার্থান্বেষীদের কাজে ব্যাঘাত ঘটত।

এই কারণে একজন মহিলার অত্যন্ত দুর্বল স্থান, তাঁর চেহারা নিয়ে কটাক্ষের অস্ত্রকে বেছে নিয়ে অবলীলায় সুচিত্রাকে অপমান করে তাঁকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। মুখ খোলেননি সুচিত্রা। স্বভাবসিদ্ধ অভিমানে চুপ করে থেকেছেন। বুদ্ধিদীপ্ত সুচিত্রা জানতেন, তিনিই মহানায়িকা। তাঁর স্থান দর্শকদের মণিকোঠায় চিরন্তন। তাই আজও টলিউডের রানী নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর রাজপাট, সুচিত্রার জীবনের নিয়ে কৌতুহল। মুকুট পড়ে আছে, রানী সশরীরে না থেকেও রয়ে গেছেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সুচিত্রার প্রয়াণ হয় না। তিনি এক চিরকালীন আত্মবিশ্বাসী নারীর প্রতিভূ। আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, মহানায়িকা। ভারতীয় সিনেমা আপনার অবদান কখনও ভুলবে না।