বয়সে প্রায় ৯ বছরের ফারাক, একজন শুরু করেছিলেন ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে আরেকজন ‘অপুর সংসার’। দেশ তখনও পরাধীন। একজন কলকাতার ছেলে আরেকজন বাংলাদেশ থেকে আসা নদিয়ার ছেলে। দু’জনের মধ্যে আজ মানুষ মিল খুজতে চাইছেন। এই মুহূর্তে যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় কে প্রিয় উত্তম ও সৌমিত্র-র মধ্যে, আপনি হয়তো ভাবতে বসে যাবেন কিংবা সটান একজনের নাম বলে দেবেন কিংবা উত্তরই দেবেন না, হয়তো ভাববেন দুজন আলাদা, তাই তুলনা নয় এবং কোনরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে না এই দুই জনের মধ্যে। কিন্তু আপনি কি জানেন এই কিংবদন্তী অভিনেতা স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মহানায়ক উত্তম কুমারকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন? আপনারা যারা ঋতুপর্ণ এবং স্টার জলসার ‘ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি’ দেখেছেন তাঁরা নিজের নিশ্চয় জানবেন যে স্বয়ং সৌমিত্র বলছেন যে উত্তম কুমার তাঁকে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। উত্তম কুমার ফাঁকা মাঠে একাই গোল দিচ্ছিলেন কিন্তু তিনি নিজে আসার পর থেকে সেই ময়দানে খেলা জমেছে। আজ আমরা কথা বলব উত্তম-সৌমিত্র-র সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে।
থিয়েটার করতেন, নাটক করতেন সৌমিত্র, কিন্তু কখনো উত্তম কুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। সৌমিত্র-র বোনের বিয়েতে প্রথম দেখা হয় উত্তম কুমারের সঙ্গে। সৌমিত্র-র শ্যালকের বন্ধু উত্তম কুমার। নিমন্ত্রিত অতিথিকে এবং বাংলা সিনেমা জগতের সুপারস্টারকে সেদিন প্রথম দেখলেন সৌমিত্র। এরপর আর দেখা হয়নি। সেই দেখা হয় তপন সিংহের ‘ঝিন্দের বন্দী’ চলচ্চিত্রে। এখানে খলনায়কের চরিত্রে উত্তম কুমারের সাথে অভিনয় করেন তিনি। তপন সিংহ এর ঝিন্দের বন্দী করতে ২১ দিন একসঙ্গে সময় কাটান এই দুই কিংবদন্তী শিল্পী। শ্যুটিং শেষে বসত বিয়ারের আসর। উভয়েই বিয়ার পছন্দ করতেন। উত্তম স্ত্রী গৌরী দেবী ছিলেন সৌমিত্রের প্রিয় বৌদি। এই বৌদির কাছে মাছ ভাঁজার আবদার থাকত তাঁর। এই গৌরী দেবী মাছ ভেজে দিতেন আর বিকেলে বসত মুড়ি সিঙ্গারার আসর। কখনো কখনো কষা মাংস রেঁধেও খাওয়াতেন উত্তম স্ত্রী। বউদি-দেওরের সমীকরণ বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। উত্তম কুমারের বাড়ির সকল অনুষ্ঠানে সৌমিত্র-র নিমন্ত্রণ বাঁধাধরা। সে তরুন কুমারের বিয়ে হোক, বা উতম কুমারের বাড়ির লক্ষ্মী পুজো বা গৌতমের বিয়ে বা নাতির পৈতে অনুষ্ঠান, এমনকি পয়লা বৈশাখে প্রনাম সারতে যেতেন সৌমিত্র।
১৯৫৮-র অগস্টে ‘অপুর সংসার’-এর শুটিং শুরু করেছিলেন সৌমিত্র। তার পর ‘দেবী’। এদিকে ১৯৫৫ থেকেই সুপারস্টারের তকমা পেয়ে গিয়েছিলেন উত্তম কুমার। ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত ‘হারানো সুর’ ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন সমগ্র ভারতজুড়ে। উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেই সময় অভিনয় প্রাঙ্গনে জন্ম নেন সৌমিত্র। যে যাই বলুক এই সৌমিত্র আজও সত্যজিৎ পুত্র। হতে পারে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ছাড়াও আরও অনেক সিনেমা করেছেন কিন্ত সত্যজিৎ রায় সৌমিত্রকে শিখিয়ে গড়ে তুলেছিলেন।’দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ জয়ী সত্যজিতের যেই ছায়া তিনি পেয়েছিলেন তা অনস্বীকার্য। অবশ্যই তিনি বহু সিনেমায় নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করেছেন কিন্তু ‘অপু’ বা ‘ফেলুদা’ না হলে হয়তো উত্তমকে ময়দানে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ভাবা সহজ হত না।
উত্তমের অভিনয় তাঁকে মুগ্ধ করত যেমন, তেমন নিজেকে প্রমাণ করার কাজে পিছুপা হননি তিনি। মহানায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে করলেন একের পর এক হিট সিনেমা। ‘ঝিন্দের বন্দী’ দিয়ে শুরু, এরপরেও সবমিলিয়ে ন’টি ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন সৌমিত্র। দর্শক মনে চিরকাল ঠাঁই পেয়েছে ‘স্ত্রী’, ‘দেবদাস’, ‘অপরিচিত’, ‘যদি জানতেম’, ‘দর্পচূর্ণে’র মতো ছবি। এক মহানায়ক বিদাই নিলেন ১৯৮০ তে আরেক কিংবদন্তী অভিনেতা বিদাই নিলেন ২০২০ তে। স্বর্ণযুগের একটা বড় অধ্যায় যেন ধীরে ধীরে সময়ের সীমারেখায় মিলিয়ে যাচ্ছে।