1985 সাল। বছর শুরুর সময়েও কেউ জানতেন না আর কয়েকদিন পরেই টলিউডের আকাশ থেকে খসে পড়বে টলিউডের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এক নক্ষত্র। সুন্দর চেহারার অর্ধেকের বেশি অগ্নিদগ্ধ। মহুয়া রায়চৌধুরী (Mahua Roychowdhury) বাঁচতে চেয়েছিলেন? নাকি বাঁচতে চাননি?
কিন্তু শিপ্রা বাঁচতে চেয়েছিল। অনেক ভালোবাসা নিয়ে, জীবনকে ভালোবেসে প্রাণোচ্ছল শিপ্রা একা বাঁচতে শেখেনি। উদয়শংকর-এর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী (Nilanjan Roychowdhury) তৎকালীন বম্বের নামী নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অসফলতাই তাঁর সাত বছরের মেয়ে শিপ্রাকে মঞ্চে তোলার জন্য একরোখা হয়ে গিয়েছিল। সেই শুরু। তৎকালীন বিখ্যাত হিন্দি গানের ছন্দে নেচে শিপ্রা রোজগার করত শৈশব থেকেই। কখন যেন হারিয়ে গিয়েছিল তার পুতুল খেলার বয়স। কেউ কি একবারও জানতে চেয়েছিলেন শিপ্রা কি চেয়েছিল?
দুঃসাহসী নীলাঞ্জনের কানে খবর এল, পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় তৈরি হচ্ছে নতুন ফিল্ম ‘নয়া মিছিল’। ফিল্মের জন্য নতুন নায়িকার খোঁজ চলছে। ফিল্মের প্রযোজক সুখেন দাস (sukhen das)। শিপ্রার হাত ধরে নীলাঞ্জন চলে এলেন স্টুডিওপাড়ায়। দেখা করলেন সুখেন দাসের সঙ্গে। সুখেনের পছন্দ হলেও অত্যধিক রোগা শিপ্রাকে পছন্দ হল না পীযূষের। ফিরেই যাচ্ছিলেন নীলাঞ্জন। শিপ্রারও মন খারাপ। হঠাৎই পিছন থেকে ডাকলেন সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত মেকআপ ম্যান জামাল ভাই। জানা গেল, তরুণ মজুমদার (Tarun majumder) তাঁর নতুন ফিল্মের জন্য নয়া মুখ খুঁজছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কনের সাজে শিপ্রাকে দেখে মনোনীত করলেন সন্ধ্যা রায় ও তরুণ মজুমদার।
‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর মিষ্টি কনে বৌ দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছিলেন। সন্ধ্যা রায় নাম দিলেন ‘মহুয়া’। তাঁর হাতেই ধীরে ধীরে কাঁচামাটির তাল পরিণত হল প্রতিমায়। ফিল্মি দুনিয়ায় নিজের আপনজন খুঁজে পেয়েছিলেন মহুয়া। দমদমে থাকাকালীন ভোরের কলটাইম থাকলে মাধবীর কাছে থেকে যেতেন। মাধবীকে তিনি বলতেন ‘মাধুমা’। ভাত না খেয়ে বেরোতে পারতেন না বলে মাধুমাই দুটো সেদ্ধ ভাত করে খাইয়ে দিতেন মহুয়াকে। প্রাণের বান্ধবী ও পাতানো বোন ছিলেন রত্না ঘোষাল যাঁকে মহুয়া তাঁর ডাকনাম ‘মাটু’ বলে ডাকতেন।
একের পর এক ফিল্মে অভিনয় করে গেছেন মহুয়া। কিন্তু তবু তাঁর মধ্যে এতটুকু অহঙ্কার ছিল না। নির্দ্বিধায় গরিব শিল্পীদের জন্য যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তেমনি ‘দাদার কীর্তি’- তে অভিনয়ের সময় নিউকামার তাপস পালকে বুঝতেই দেননি, তিনি তাঁর থেকে সিনিয়র। কিন্তু এত হাসি, গল্প সবকিছুর পিছনে ছিল একাকীত্ব। তাই হয়তো প্রেমে পড়েছিলেন। বিখ্যাত নায়িকা মহুয়া প্রেমে পড়েছিলেন কিশোরকন্ঠী গায়ক তিলকের। অখ্যাত তিলককে বাবার অমতে বিয়ে করেছিলেন মহুয়া। আসলে নীলাঞ্জন চাননি, মেয়ের রোজগারের টাকা তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে যাক।
এবার শুরু হল তিলককে দাঁড় করানোর লড়াই। তিলকের দাদা অলোক চক্রবর্তী (alok chakraborty) তিলক-মহুয়া জুটিকে নিয়ে প্রযোজনা করলেন ফিল্ম ‘আনন্দমেলা’। সামান্য ব্যাঙ্কের চাকুরে অলোকের কাছে কোথা থেকে এসেছিল প্রযোজনার টাকা? সুপারফ্লপ হল ফিল্ম। তিলক তিমিরেই রয়ে গেলেন। কিন্তু মহুয়া উঠে এলেন খ্যাতির শীর্ষে। তার সাথেই এবার শুরু হল তিলক ও মহুয়ার বেপরোয়া জীবনযাপন। ততদিনে তাঁরা উঠে এসেছেন টালিগঞ্জের ভাড়াবাড়িতে। মাঝরাতে বাইকে করে কলকাতার রাস্তায় ঘোরা, মদের ফোয়ারা ছোটানো শুরু হল। এর মধ্যেই জন্ম হল তাঁদের পুত্রসন্তান ‘গোলা’-র । মহুয়ার জন্মদিনেই গোলার জন্ম হল। সেই সময় কলকাতার বুকে পেলে ও কসমস দল, মোহনবাগানের সঙ্গে ম্যাচ খেলতে এসেছেন। চারপাশের ‘গোল’ ‘গোল’ ধ্বনির মধ্যে ছেলের জন্ম হয়েছে। তাই ফুটবলপ্রেমী মহুয়া ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘গোলা’।
এরপর থেকেই যেন পাল্টে গেলেন মহুয়া। রত্না ঘোষাল জানিয়েছেন, সুরাসক্তি মারাত্মক বেড়ে গিয়েছিল। মদ খেলেই নতুন পুরুষ চাইতেন। কিন্তু যখন হুঁশ ফিরে আসত, তখন রত্নার মুখে নিজের ঘটনা শুনে নিজেই বিশ্বাস করতে পারতেন না। তিলক একদিকে চূড়ান্ত অসফল, অপরদিকে স্ত্রীর এই ধরনের আচরণে সহ্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছিলেন। এর উপর মহুয়ার টালিগঞ্জের বাড়িতে এসে জুটেছিলেন নীলাঞ্জন। তিলক ও নীলাঞ্জনের সহাবস্থান তৈরি হয়েছিল। 3 রা জুলাই-এর পর মহুয়ার বাংলাদেশ চলে যাওয়ার কথা ছিল। মুমতাজ আলমের ‘ঊশীলা’ ফিল্মের নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল মহুয়ার। ভিসার অপেক্ষা করছিলেন মহুয়া।
ভিসার ডকুমেন্টস কি সত্যিই আসেনি? নাকি মহুয়া অবধি পৌঁছাতে দেওয়া হয়নি! নামী এক পরিচালকের বাড়িতে সেদিন পার্টি ছিল। মদ খেয়েছিলেন মহুয়া। বাড়ি ফিরে বাইরের পোশাক ছেড়ে নাইটি পরেছিলেন। মাঝরাতে গোলার জন্য স্টোভ জ্বেলে দুধ গরম করতে গিয়েছিলেন মহুয়া। অথচ বাড়িতে কিন্তু দুজন পরিচারক ছিল। স্টোভ বার্স্ট করেছিল কি? যদি বার্স্ট করে থাকে তাহলে কখনও অত্যন্ত কম কেরোসিন ভরা একটি অক্ষত স্টোভ কি করে পুলিশের হাতে এল? রান্নাঘরে স্টোভ বার্স্ট করার কোনো চিহ্ন ছিল না। অথচ শোবার ঘরের গোটা বিছানা অস্বাভাবিক ভাবে পুড়ে গিয়েছিল। নাইটি ও বিছানায় ছিল কেরোসিনের গন্ধ। সারা শরীর জুড়ে ছিল কালশিটের দাগ, মুখের ডানদিকে ছিল ব্লেড দিয়ে কাটার ক্ষত। পিঠ, তলপেট, উরু ভয়াবহ দগ্ধ। সত্তর শতাংশের বেশি পুড়ে গিয়েছিলেন মহুয়া। তিলক বলেছিলেন, দূর্ঘটনা নাকি ডিনারের পর ঘটেছিল। অথচ মহুয়া তো সেই নামী পরিচালকের বাড়ি থেকে ডিনার করেই এসেছিলেন। তিলক ও নীলাঞ্জনের চোট লাগেনি। অথচ তাঁরা নাকি মহুয়াকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন।
ভর্তি করা হয়েছিল নামী বেসরকারি হাসপাতালে। মহুয়ার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নিয়েছিলেন তৎকালীন সিআইডি অফিসাররা, ডেপুটি সুপারিটেন্ডেন্ট অফ পুলিশ এন.সি.বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্সপেক্টর এ.এন.দুবে। সেই মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে সই করেছিলেন মহুয়ার দাদা পিনাকী রায়চৌধুরী ও সিস্টার ঊষা। রত্না ঘোষাল উপস্থিত ছিলেন। মহুয়া জানতেন, তিনি আর বাঁচবেন না। তাই প্রিয় বান্ধবী মাটুর দুটি হাত ধরে নিজের একমাত্র পুত্রসন্তান গোলাকে দেখার অনুরোধ করেছিলেন।
মহুয়ার ফাইল কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। ধুলো জমেছে তার উপর। সবকিছু দেখে-শুনে অনায়াসেই মনে হচ্ছে, নীলাঞ্জন ভেবেছিলেন, মহুয়া বাংলাদেশ চলে গেলে যদি তাঁর হাত থেকে সোনার ডিম পাড়া রাজহংসী বেরিয়ে যায়! তার সাথেই যুক্ত হয়েছিল বিখ্যাত স্ত্রীর প্রতি তিলকের মেল ইগোর সমস্যা কারণ মহুয়ার মৃত্যুর সময়েও তাঁর হাতে ছিল কুড়িটি ফিল্ম। সেজন্যই কি সেই রাতে পার্টি থেকে ফেরার পর বেধড়ক মেরে, ব্লেড দিয়ে মহুয়ার চেহারা নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল যাতে তিনি আর নায়িকা না হতে পারেন! হয়তো তাতে কাজ না হওয়ায় যে স্টোভ বার্স্ট করার কথা বলা হয়েছিল সেই স্টোভ থেকেই কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মহুয়ার শরীরে! মৃত্যুর কারণ ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। বছরের পর বছর ধরে মৃত্যুবার্ষিকীতে মিডিয়ার লেখনী গড়ে উঠবে মহুয়াকে নিয়ে। কিন্তু কোনোদিন কেউ জানবে না, মহুয়া আসলে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, একটু ভালোবাসা চেয়েছিলেন। কিন্তু 1985 সালের 22 শে জুলাই এক অশ্রুসিক্তা মা তাঁর শেষ ভালোবাসা, একরত্তি পুত্রসন্তানকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন না ফেরার দেশে।
View this post on Instagram