2005 সালের জানুয়ারি মাস, মুম্বইয়ের একটি অভিজাত রেসিডেন্সিয়াল সোসাইটির একটি বাড়ির বাইরে কয়েকদিন ধরে জমা হচ্ছিল সংবাদপত্র ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ সামান্য কটু গন্ধ পাচ্ছিলেন বাড়ির বাইরে। তাঁরাই উদ্যোগী হয়ে স্থানীয় থানায় খবর দেন। পুলিশ এসে বাড়ির তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। সেই বাড়ির বিছানায় তখন নিশ্চিন্তে চিরঘুমের দেশে চলে গেছেন বলিউডের কিংবদন্তী, যিনি বেঁচে থাকতে কেউ কোনোদিন তাঁকে ‘কিংবদন্তী’-র আখ্যা দেননি, সেই পরভিন বাবি (parvin babi)।
সময়টা ছিল বলিউডের স্বর্ণযুগ। হেমা মালিনী (Hema malini), শর্মিলা ঠাকুর (sharmila tagore)-রা মাতিয়ে রেখেছিলেন রূপোলি পর্দা ও বলিউডের ফিল্মি পার্টি। সাদা শাড়ি, বুফো খোঁপা, হাতে ধরা কোকাকোলার গ্লাসের মাঝে হঠাৎই এসে উপস্থিত হলেন রেশম কালো লম্বা চুলের এক বোহেমিয়ান সুন্দরী। তৎকালীন সময় তাঁর পরনে রিপড জিনস ও ঠোঁটে সিগারেট। বলিউডের নায়কদের চোখ টেনে নিলেন তিনি। পরভিন বাবি নামের সেই সুন্দরী কিন্তু অবলীলায় নিজের জায়গা করে নিতে শুরু করলেন বলিউডে। অথচ বলিউডে তাঁর কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। জুনাগড়ের একটি ধার্মিক মুসলিম পরিবারে জন্ম হওয়া পরভিন অতি শৈশবে পিতৃহারা হয়েছিলেন। বাবা-মার সূত্রে পরভিন সান্নিধ্য পেয়েছিলেন জুনাগড়ের নবাব পরিবারের। কিন্তু বাবার মৃত্যু পরভিনের জীবনের ভিতকে ভিতরে ভিতরে ভেঙে দিয়েছিল। তবে পরভিন নিজেকে শক্তিশালী রাখার চেষ্টা করতেন। পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলেন পরভিন। আহমেদাবাদের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরাজিতে স্নাতক হওয়ার পর পরভিন 1973 সালে ‘চরিত্র’ ফিল্মের মাধ্যমে বলিউডে ডেবিউ করেন।
View this post on Instagram
‘চরিত্র’ ফ্লপ হলেও পরভিনের সিজলিং লুক সকলের নজর কেড়েছিল। 1974 সালে ‘মজবুর’ ও 1975 সালে ‘দিওয়ার’-এর মাধ্যমে পরভিন অভিনয়েও মাইলস্টোন তৈরি করেন। ‘দিওয়ার’-এ পরভিন দেহোপজীবিনীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। ফিল্মফেয়ার, স্টারডাস্টের মতো ফিল্মি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে পরভিনের ছবি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 1976 সালে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে পরভিনের ছবি প্রকাশিত হয়। পরভিন ছিলেন প্রকাশিত প্রথম ভারতীয় যাঁর ছবি ‘টাইম’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ইতিহাস তৈরি করেছিলেন পরভিন। ড্যানি (danny)-র গার্লফ্রেন্ড পরভিনের সফলতায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁর জীবনে এসেছেন কবীর বেদী (kabeer bedi)। ড্যানির কাছ থেকে একসময় পরভিনকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন কবীর। ছেড়ে এসেছিলেন নিজের স্ত্রী প্রতিমা (pratima bedi)-কেও। কবিরের সঙ্গে কিছুদিন লিভ-ইন করেছিলেন পরভিন। কিন্তু কবীরের মতো পুরুষকে বিশ্বাস করতে বোধ হয় কষ্ট হয়েছিল পরভিনের। তিনি মহেশ ভাট ( mahesh bhatt)-এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর কাঙ্খিত ভালোবাসা।
View this post on Instagram
মহেশ চেয়েছিলেন পরভিনের সঙ্গে ঘর বাঁধতে। তখনও তিনি নামী পরিচালক-প্রযোজক নন। কিন্তু পরভিনের জীবনের চিত্রনাট্য হঠাৎই বদলে গিয়েছিল 1983 সালে। দশ বছরের ফিল্মি কেরিয়ারে প্রায় পঞ্চাশটি ফিল্মে অভিনয় করা পরভিন হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে। অনেকে বলতে শুরু করলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের চাপে সরে গেছেন পরভিন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল পরভিন সেই সময় থেকেই প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। নিজেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূরে রাখতে পরভিন তাঁর বন্ধুদের সাথে পাড়ি দিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া। কিন্তু শেষ অবধি পরভিন তাঁর অসুখ লুকিয়ে রাখতে চাইলেও 1989 সালে তা সবাই জেনে গিয়েছিলেন। একটি ফিল্ম ম্যাগাজিনে পরভিন অমিতাভ বচ্চন (Amitabh bachchan)-কে আন্তর্জাতিক মাফিয়া বলেছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকারের অসংলগ্নতাই তাঁর অসুস্থতার কথা সকলের সামনে এনে দেয়। একসময় পরভিন প্রাণ হারানোর ভয় পেতে শুরু করেন। তাঁর ধারণা ছিল তাঁকে খুন করা হবে। এমনকি জরুরি কাগজপত্র হারিয়ে ফেলতেন। একবার জন.এফ.কেনেডি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এই কারণে আইনি জটিলতায় ফেঁসে গিয়েছিলেন। 2002 সালে পরভিন জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে 1993 সালের মুম্বই বিস্ফোরণে সঞ্জয় দত্ত (sanjay dutt)-এর জড়িত থাকার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু এই মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট দিনে কোর্টে হাজির হননি অভিনেত্রী।
জীবনের শেষ চার বছর প্রতিটি ফোন কল রেকর্ড করতেন পরভিন। মহেশ ভাট শেষ অবধি তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করলেও পরভিন তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অভিনেত্রী ধীরে ধীরে হাঁটার শক্তি হারিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর বিছানার পাশে একটি হুইলচেয়ার পাওয়া গিয়েছিল। গোটা শরীর গ্যাংগ্রিন হয়ে মারা গিয়েছিলেন পরভিন। তাঁর মৃত্যুর বাহাত্তর ঘন্টা পর পুলিশ তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে কুপার হাসপাতালে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠায়। শেষ জীবনে খ্রিস্টান হয়ে গেলেও, পরভিনের পরিবারের দাবি মেনে মুসলমান রীতি অনুযায়ী তাঁর শেষকৃত্য হয়। তাঁর জানাজায় উপস্থিত ছিলেন ড্যানি, কবীর, মহেশ। পরভিন চলে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটি প্রশ্ন আজও ভাবায়, পরভিন স্কিৎজোফ্রেনিক হলেও বলিউড সম্পর্কে তাঁর সমস্ত দাবিই কি মিথ্যা ছিল? কাকে এত ভয় পেতেন পরভিন? সুশান্ত (sushant singh Rajput)-ও জীবনের শেষ দিকে মানসিক অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সুশান্তও মৃত্যুর আগে প্রাণভয় পেতেন। কোথাও কি কোনো যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে? দুটি মৃত্যু, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিতর্ক, প্রাণের ভয়, অল্প দিনের কেরিয়ারে ইতিহাস সৃষ্টি করার মতো সফল দুই তারকা। দুই মৃত্যুর মাঝখানে বহু বছরের ব্যবধান। কিন্তু কোথাও বলিউডের অন্দরে কিছু রহস্য লুকিয়ে নেই তো?