Bikini Controversy: বিকিনি কি সত্যিই অনাবৃত করেছে নারীকে!
বিকিনি বারবার বিতর্কিত হয়েছে। একসময় তা হয়ে উঠেছে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার সমার্থক। কিন্তু হঠাৎই বিকিনি কেন প্রবেশ করল সৌন্দর্যের নিরিখে তা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে চল্লিশের দশকে। পৃথিবীর কোনো দেশেই নারী সেই সময় খোলামেলা পোশাক পরার পক্ষপাতী ছিলেন না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে তাঁর সৌন্দর্যকে বুঝতেও পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে তোলা হচ্ছিল। সমাজে নারীর অবস্থান ছিল নিম্নগামী। নারীরা কিন্তু বরাবর সাহসী। তবু তাতে ইন্ধনের অভাব ছিল। সমুদ্রস্নানের জন্য চল্লিশের দশকে নারীদের সঠিক পোশাক ছিল না। ফলে সমুদ্রে নামলে ঢেউয়ের কারণে পরনের পোশাক সরে গিয়ে লজ্জার সম্মুখীন হতেন মেয়েরা। মূলতঃ মেয়েদের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি দিতেই 1946 সালে প্যারিসের ফ্যাশন ডিজাইনার জ্যাকিস হেইম (Jacques Heim) তৈরি করলেন একটি বিশেষ পোশাক যা দুই ভাগে বিভক্ত। উর্ধ্বাঙ্গে একটি ছোট স্লিভলেস টপ ও নিচে হাই ওয়েস্ট শর্ট প্যান্ট। এই পোশাকের নাম হল ‘অ্যাটম’। কিন্তু পোশাকটির কোনো আকর্ষণ তৈরি হল না। এরপরেই লুই রিয়ার্ড (Louis Reard) ডিজাইন করলেন এই পোশাকটির একটি অন্য রূপ। টপটি হয়ে গেল আরও ছোট। হাই ওয়েস্টের পরিবর্তে শর্ট প্যান্ট শুরু হল নাভির নিচ থেকে। এই পোশাক ডিজাইন হওয়ার মাত্র চারদিন আগে একটি প্রবাল প্রাচীরে হয়েছিল প্রথম পরমাণু বোমার পরীক্ষা।
View this post on Instagram
প্রবাল প্রাচীরটির নাম ছিল ‘বিকিনি অ্যাটল’। এই ঘটনাকে মাথায় করে লুই পোশাকের নামকরণ করলেন বিকিনি। পোশাকটি একটু খোলামেলা হয়ে গেলেও মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগল।
View this post on Instagram
কিন্তু তবু কোনো সুন্দরী বিকিনি মডেল হতে রাজি হলেন না। শেষ অবধি মিশেলিন বার্নার্ডিনি (Micheline Bernardini) নামে এক নর্তকী রাজি হলেন বিকিনি পরতে।
View this post on Instagram
বিকিনি পাল্টে দিল তাঁর জীবনকে। রাতের পর রাত পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টির সামনে নগ্ন হয়ে নাচ করতেন মিশেলিন। কিন্তু বিকিনি তাঁকে বানাল রাতারাতি মডেল। প্যারিসের ক্যাসিনোয় নগ্ন নাচ করতে করতেই হয়তো একদিন শেষ হয়ে যেত তাঁর জীবন। বিকিনি মিশেলিনকে দিল নতুন করে বাঁচার সুযোগ। সাথেই জন্ম নিল বিতর্ক।
View this post on Instagram
কিন্তু সত্যিই কি মহিলারা এই ধরনের পোশাকের কল্পনা কখনও করেননি? মনে মনে হয়তো তাঁরাও চেয়েছিলেন ভারি পোশাকের হাত থেকে মুক্তি। ফলে বিকিনির আগে একটি বিশেষ পোশাকের আবির্ভাব ঘটেছিল ত্রিশের দশকে। পোশাকটি ছিল একটি শর্ট স্কার্ট ও স্লিভলেস শর্ট টপ। 1935 সালে প্রথমবার এই পোশাক পরে ক্যামেরাবন্দি হয়েছিলেন মেক্সিকান অভিনেত্রী দোলোরেস দেল রিও (Dolores Del Rio)। তবে শর্ট স্কার্ট পরে সমুদ্রে গিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণে এই পোশাকটি জনপ্রিয় হয়নি। তবু এটিকেই বিকিনির আদি রূপ বলে মনে করা হয়।
View this post on Instagram
কিন্তু বিকিনি শুধুমাত্র একটি পোশাক রূপেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি সন্ধান দিয়েছিল নতুন পেশার। 1951 সালে এরিক মোর্লে (Eric Morley) নামে এক ব্যক্তি আয়োজন করলেন একটি বিকিনি কনটেস্ট। সেই বছর এই প্রতিযোগিতা ব্রিটেনের উৎসবগুলির অন্তর্গত হয়ে গেল। বিকিনির বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তিত রূপ তৈরি হতে লাগল। এই ধরধের বিকিনিগুলি সেই সময় তৈরি করতেন স্থানীয় ডিজাইনাররা যাঁদের প্যারিস যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য ছিল না। বিকিনি তাঁদের দিল পরিচিতি। ছিলেন কয়েকজন মডেল যাঁদের উপার্জনের উপর চলত তাঁদের সংসার। তাঁদের হাতে বাড়ল কাজ। জন্ম হল ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ কনটেস্ট-এর।
View this post on Instagram
সেই সময় ‘মিস ওয়ার্ল্ড’-এ বিকিনির মাধ্যমে শারীরিক সৌন্দর্য যাচাই করে বেছে নেওয়া হত যোগ্য প্রতিযোগীকে। প্রকৃত অর্থে বিকিনি-পূর্ববর্তী সময় থেকেই নারীর সৌন্দর্যের মাপকাঠি তৈরি করতে শুরু করেছিল সমাজ। সমগ্র পৃথিবীতে এবং পূরাণ কাহিনীতেও নারীর স্তন ও কোমরের মাপ বর্ণিত রয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের গাউন ও আঞ্চলিক পোশাকের মাধ্যমে সেই মাপ সঠিক রূপে বোঝা সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার সমাধান করেছিল বিকিনি। ফলে ‘মিস ওয়ার্ল্ড’-এ বিকিনিকেই মূল পোশাক হিসাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এমনকি এই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার অনুকরণে তৈরি বাকি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাগুলিও এই কাঠামো অনুসরণ করতে শুরু করে। তবে সেই সময় প্রতিযোগীর পরনের বিকিনি খোলামেলা হত না। বর্তমানে যাকে সুইমসুট বলা হয়, সেই সময় তা পরেই মার্জার সরণিতে হাঁটতেন প্রতিযোগীরা। ওই পোশাকই ফাইনাল রাউন্ড অবধি পরে থাকতে হত।
View this post on Instagram
1966 সালে ভারতীয় কন্যা রিটা ফারিয়া (Reita Faria)-র মাথায় ওঠে ‘মিস ওয়ার্ল্ড’-এর মুকুট। তিনিই ছিলেন প্রথম এশিয়ান মহিলা যিনি ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতা যেতেন। কিন্তু 1965 সালে ‘মিস ইন্ডিয়া’-য় অংশগ্রহণের সময় রিটার কাছে কোনো বিকিনি ছিল না। সেই সময় বিকিনি অধিকাংশ ভারতীয় মহিলার কাছে ‘বেদিং কস্টিউম’ নামে পরিচিত ছিল। সেই বছর রিটার সহ-প্রতিযোগী পার্সিস খাম্বাট্টা (Persis Khambatta) তাঁকে নিজের বিকিনি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
View this post on Instagram
2014 সালে প্রাক্তন ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ ঐশ্বর্য রাই বচ্চন (Aishwarya Rai Bachchan) এই প্রতিযোগিতার প্রেসিডেন্ট জুলিয়া মোর্লে (Julia Morley)-কে বলেন, ভারত সহ বহু দেশের মেয়েরাই বিকিনি পরে সকলের সামনে হাঁটতে অস্বস্তি বোধ করেন। এরপর এই রাউন্ডটি মঞ্চে বাতিল করলেও জুলিয়া সি-বিচের জন্য একটি বিশেষ সুইমসুট রাউন্ড তৈরি করেন।
View this post on Instagram
বিকিনি বারবার বিতর্কিত হয়েছে। কিন্তু তা কতটা প্রাসঙ্গিক? একটি শাড়িও তো বিভিন্ন ভাবে পরা যায়। অনেকেই শাড়ি যথেষ্ট খোলামেলা ভাবে পরেন। বিকিনিরও বিভিন্ন রূপ রয়েছে। অনেকে পছন্দ করেন খোলামেলা বিকিনি পরতে। অনেকে পরেন সামান্য আবৃত বিকিনি যার আরেক নাম মনোকিনি। কিন্তু বিকিনি বা মনোকিনি ছাড়া কি সত্যিই সমুদ্রস্নান সম্ভব? ভারতীয় মহিলারা অনেকেই সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি পরে সমুদ্রে নেমে জলের তোড়ে পোশাক এলোমেলো হয়ে অবর্ণনীয় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বর্তমানে বিকিনি নিয়ে বিদেশে ততটা ছুঁৎমার্গ না থাকলেও ভারতে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার অবতারণা করতেই হয়। একসময় ভারতীয় মহিলারা নগ্ন শরীরে শাড়ি পরতেন। শীতকালে তার উপরেই জড়িয়ে নিতেন একটি শাল।
View this post on Instagram
ব্লাউজের আদিরূপ সেমিজের প্রবর্তন হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের হাত ধরে। প্রথমদিকে মহিলারা সেমিজ পরে নিজেকে আবৃত করে তার উপর শাড়ি পরলে সমাজে তা নিয়েও তাঁদের যথেষ্ট নিন্দার সম্মুখীন হতে হত। নারীর আবরণকে মানতেও সমাজের সময় লেগেছিল।
View this post on Instagram
প্রকৃতপক্ষে, আজ হয়তো বিকিনি নিয়ে এত লিখতে হত না যদি মানুষ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতেন। হাতে স্মার্টফোন নিয়ে মধ্যযুগীয় মানসিকতার মানুষগুলিই কিন্তু রাতে মহিলাদের বিকিনি পরিহিত ছবি দেখেন। ‘বেশরম রং’ নিয়ে গোটা ভারতজুড়ে বিতর্ক হচ্ছে কারণ যাঁরা বিতর্ক তৈরি করছেন তাঁরা এই গানের ভিডিওটি দেখেছেন। কেন দেখলেন? গানটি তো কানেও শোনা যায়? আর কতদিন এড়িয়ে চলবেন বিকিনির সৌন্দর্যকে? কতদিন নারীকে আটকে রাখবেন স্নানের উপযোগী সঠিক পোশাক পরা থেকে? হয়তো এই প্রতিবেদন পড়ার পরেও বোঝেননি অনেকে। বুঝবেনও না। প্রকৃতপক্ষে, পুরোটাই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। নাহলে এখনও সমাজে ‘মেয়ে দেখা’ -র অযৌক্তিক প্রথার অস্তিত্ব থাকত না।
View this post on Instagram