বিদেশ থেকে ফেরার পর চিনতে পারেনি সন্তান, আড়ালে চোখের জল ফেলেছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী
সন্ধ্যেবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাংলা সিরিয়ালে চোখ রাখা বর্তমানে মানুষের একটি অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। এই অভ্যাস যে খারাপ হয়েছে সব সময় তেমনটা নয়, প্রথমা কাদম্বিনী যিনি ইতিহাসের পাতাতেই ধামাচাপা পড়েছিলেন এবং শিক্ষিত সমাজের কয়েকটা স্তরেই তিনি আবদ্ধ ছিলেন, সিরিয়ালের দৌলতে কিন্তু বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছেন প্রথমা কাদম্বিনী। দুটি বড় বড় চ্যানেলে একসঙ্গে শুরু হয়েছিল এই কাদম্বিনীকে নিয়ে বায়োপিক। ঘটনার মধ্যে অতিরঞ্জিত থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজেই পৌঁছে যায় কাদম্বিনীর নাম।
এ যুগের প্রথম মহিলা ডাক্তার। এই নিয়েই এক নারীর লড়াইয়ের গল্প। সংসার সামলেও কিভাবে পড়াশোনা করে সমাজের এতগুলো চোখ রাঙ্গানোকে সহ্য করেও নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়, তার উদাহরণ বহুদিন আগেই কাদম্বিনী দিয়ে গেছিলেন। উনিশ শতকের শেষভাগে তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসায় ডিগ্রি অর্জন করেন এবং আনন্দিবাই জোশির সাথে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথম দিককার একজন নারী চিকিৎসক। বিহারের ভাগলপুরের ব্রাম্ভসমাজ ব্রজেশ্বর বসতবাড়িতে ১৮ জুলাই আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন কাদম্বিনী। একসময় দ্বারকানাথের পোলিও আক্রান্ত ছেলেকে জ্বরের সময় মাথা ধরে তার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন কাদম্বিনী। ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা করার জন্য অনেকেই তাঁর প্রশংসা করেছিল। তার মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার।
স্কুল জীবনে শুধু পড়াশোনা নয়, অনেক বিষয়েই কাদম্বিনীর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এরপরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, তারপরে বেথুন কলেজ তারপরে প্রথম গ্রাজুয়েট হিসাবে তিনি বিএ পাস করেন। অ্যাডমিশন এর পরেই কাদম্বিনী সিদ্ধান্ত নেন তিনি ডাক্তারি পড়বেন। তবে পড়াশোনা করার আগেই কাদম্বিনীর সংসারে প্রবেশদ্বার কাকে বিবাহ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসা থেকে চিকিৎসা করার অনুমতি পেয়েছিলেন। কলেজে পড়াকালীন তিনি স্কলারশিপ কুড়ি টাকা। পরবর্তীকালে তিনি লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসিক ৩০০টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বিবাহের পরে তিনি আট সন্তানের মা হন সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি করার পরেও তিনি নিজের কাজকে চালিয়ে গেছেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ৩রা অক্টোবর কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায় একটি অপারেশন শেষে বাড়ি ফেরার সময় পথে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
সবচেয়ে সাহসী বিষয় যেটি না বললেই নয় তা হলো সন্তানদের ফেলে তিনি বিদেশে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন। তাকে নানান রকম কটূক্তির শিকার হতে হয়েছিল, তবে বর্তমানেও এমনটা কি হতে হয়না? সংসার কে অবহেলা করে যদি নিজের কাজকে বেশি গুরুত্ব দেয় কোন নারী, তাহলে তাকে এখনো সমাজ কটুক্তি করে। শোনা যায়, কাদম্বিনী ফিরে এসে ছোট ছেলেকে কোলে নিতে গেলে বছর দেড়েকের ছেলে তাকে চিনতে পারেনি। গলা জড়িয়ে ধরেছিল কাদম্বিনীর মাকে। আড়ালে চোখের জল ফেলে ছিলেন তিনি। কখনোই তার সংসার তার ক্যারিয়ারের অন্তরায় হয়নি। কতদিন আগেও তিনি কতটা আধুনিক মানসিকতার ছিলেন এই ঘটনা বুঝি তাই প্রমাণ করে।
প্রবাদে আছে, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে এই প্রবাদকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি করে তুলেছেন এই প্রথমা কাদম্বিনী। একবার নেপালের রাজা জংবাহাদুর এর মা খুবই অসুস্থ ছিলেন তখন কাদম্বিনী কে ডেকে পাঠানো হয়। কাদম্বিনীর ওষুধের রাজমাতা সুস্থ হন। সেই হিসাবে কাদম্বিনীকে প্রচুর উপহার দেওয়া হয়। নামি দামি পাথর বসানো সোনার গয়না রুপোর বাসন ইত্যাদি তাকে দেওয়া হয়েছিল। তাকে একটি সাদা রঙের টাট্টু ঘোড়া উপহার দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘোড়ার গাড়িতে করেই তিনি এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি সমানে ছুটে যেতেন চিকিৎসা করতে। আর মাঝে যতটুকু সময় পেতেন সেই সময় তিনি সমানে লেস বুনে যেতেন।