Lily Chakraborty: বম্বের সম্ভাবনাময় কেরিয়ার ছেড়ে বাংলাকে ভালোবেসেছেন লিলি চক্রবর্তী
বাংলা সিনেমার বরাবরের একটি অনুযোগ রয়েছে। এখনও অবশ্য তা আড়ালে-আবডালে বর্তমান। অনুযোগটি হল, মুম্বইয়ে তাবড় নায়িকাদের পাশে সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen) ছাড়া বাকি অভিনেত্রীরা ম্লান। সত্যিই কি তাঁরা ম্লান? নাকি নক্ষত্রের আলো হরণের চেষ্টা হয়? দুটি প্রশ্নের একটি উত্তর, লিলি চক্রবর্তী (Lily Chakraborty)। বর্তমানে স্নেহময়ী দিদা-ঠাকুমার চরিত্রাভিনেত্রী লিলি কিন্তু একসময় গ্ল্যামারের ছটায় আলোকিত করে দিতেন চারিদিক।
View this post on Instagram
সৃজিত মুখার্জী (Srijit Mukherjee) পরিচালিত ফিল্ম ‘রাজকাহিনী’ খ্যাত অভিনেত্রী লিলি সত্যিই ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাক্ষী। তবে তিনি তখন নেহাতই একরত্তি বালিকা। অবিভক্ত বাংলার ঢাকায় জন্ম হয়েছিল লিলির। 1946 সালে সপরিবারে তাঁরা চলে এসেছিলেন কলকাতায়। লিলির তখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স। ঢাকায় তাঁর বাবার বড় ব্যবসা ছিল। কিন্তু তাতে লোকসান দেখা দেয়। এর ফলেই কলকাতায় আসতে হয় তাঁদের। কলকাতায় এসে বালিগঞ্জে কাকার বাড়িতে এক বছর ছিলেন। কিন্তু কলকাতার বুকে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন ঢাকা থেকে আসা পরিবারটি। ফলে বাবা, মা ও ভাই-বোনদের সাথে মধ্যপ্রদেশে তাঁর বড়মামার বাড়িতে চলে আসেন লিলি। দেশভাগ তাঁকে স্পর্শ করেনি। বরং 1947 সালের পনেরই অগস্ট বড়মামার বাড়িতে থাকাকালীন যথেষ্ট হইহই করে খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল। বাড়িতে এসেছিলেন অতিথিরা। সবকিছুই এখনও আবছা মনে আছে লিলির। দশ বছর বয়সে আবারও তাঁকে ফিরতে হয়েছিল কলকাতায়। সেই সময় বেলুড়ে ছোটমামার কাছে থাকতেন তিনি। বাড়ির সামনের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল তাঁকে। মধ্যপ্রদেশে থাকাকালীন মায়ের কাছে বাড়িতে পড়াশোনা কিছুটা শিখেছিলেন লিলি। ফলে স্কুলের পড়া সহজেই বুঝতে পারতেন তিনি। দিনগুলি বেশ ভালোই কাটছিল লিলির।
কিন্তু বারো বছর বয়সে তাঁর টাইফয়েড ধরা পড়লে আবারও লিলির মা মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন মধ্য প্রদেশ। সেখানেই একটি কো-এড স্কুলে ভর্তি হলেন লিলি। বান্ধবীদের সাথে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে স্কুলে পৌঁছাতেন তিনি। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কলকাতা টানত লিলিকে। হয়তো বা এখানেই ছিল ভবিতব্য! তবে বংশানুক্রমিক ভাবেও তাঁর মধ্যে রয়েছে অভিনয়ের ক্ষমতা। লিলি নিজেই জানিয়েছেন, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময় তাঁর মা বাড়িতেই ভাই-বোনদের দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করাতেন। এই ভাবেই লিলির মনের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল অভিনেত্রী হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা। গরমের ছুটিতে মা ও ভাই-বোনদের সাথে মাঝেসাঝে বেড়াতে এলেও শেষ অবধি লিলির পরিবারকে থিতু হতেই হল কলকাতায়। উল্টোডাঙার মুরারীপুকুর রোডে থাকতে শুরু করলেন তাঁরা। কিন্তু গরমের ছুটিতে লিলি যখন আসতেন, তখন থেকেই তাঁকে ঘিরে ধরেছিল সিনেমা। উত্তম কুমার (Uttam Kumar), সুচিত্রা সেনের গুণমুগ্ধ ছিলেন তিনিও। লিলির অজান্তেই হয়তো ভবিষ্যতের মালা গাঁথছিলেন ভাগ্যবিধাতা।
মুরারীপুকুরের বাড়িতে থাকাকালীন লিলির মেজদিদি থিয়েটার করতে শুরু করেন। থিয়েটারের সামান্য অর্থে চলত তাঁদের সংসার। মেজদিদির সাথেই একবার ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নাটকের রিহার্সাল দেখতে গিয়েছিলেন লিলি। তন্ময় হয়ে সকলের অভিনয় দেখছিলেন তিনি। চমক ভাঙে পরিচালকের ডাকে। তিনি লিলিকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান লিলি। থিয়েটার করতে করতেই পরিচালক কুণাল মুখার্জী প্রস্তাব দিলেন সিনেমায় অভিনয়ের। তিনি ছিলেন কনক মুখার্জী (Kanak Mukherjee)-র ভাই। ‘ভানু পেল লটারি’-র মাধ্যমে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করলেন লিলি। তাঁর বারবার মনে হচ্ছিল যেন সব নিজে থেকেই হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, লিলির অভিনয়ে ছিল না অতিনাটকীয়তা। তিনি স্বাভাবিক অভিনয় করতেন। তা সকলকে আকর্ষণ করেছিল।
View this post on Instagram
‘ভানু পেল লটারি’-তে সকলকে অবাক করে দিয়ে কমল মিত্র (Kamal Mitra) ও জহর রায় (Jahar Ray)-এর সাথে সাবলীল অভিনয় করলেন লিলি। এই ফিল্মের ক্যামেরাম্যান এরপর পরিচালক অভি ভট্টাচার্য (Abhi Bhattacharya)-র কাছে লিলির সুপারিশ করেন। লিলি কিন্তু এত কিছু তখনও জানতেন না। ‘মধ্যরাতের তারা’-য় ছবি বিশ্বাস (Chabi Biswas)-এর মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করে আবারও তাক লাগিয়ে দিলেন লিলি। নবাগতার অভিনয় দক্ষতা চোখে পড়ল ছবি বিশ্বাসের। তিনি নিয়ে এলেন স্টার থিয়েটারে। স্টার থিয়েটারে আসার পর অনেকগুলি বাংলা ফিল্মে অভিনয় করলেন লিলি। কিন্তু নায়িকা নয়, ছিল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তবে লিলির হাত ধরেই আবারও ফিরেছিল তাঁদের সংসারের আর্থিক উন্নতি। কলেজে পড়ার স্বপ্ন থাকলেও পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে তা বাস্তবায়িত করতে পারেননি লিলি। সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)-ও ‘অপুর সংসার’-এ অপর্ণার চরিত্রের জন্য লিলিকে পছন্দ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আরও একটি নতুন মেয়ের সাথে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মেয়েটি যদি অপর্ণার চরিত্রে অভিনয় না করেন তাহলে লিলিই চরিত্রটি করবেন। কিন্তু সেদিনের নতুন মেয়ে শর্মিলা ঠাকুর (Sharmila Tagore) রাজি হয়েছিলেন অপর্ণা হতে। অপরদিকে সত্যজিৎ লিলিকে কথা দিয়েছিলেন, কাজ করবেন তাঁর সাথে। কথা রেখেছিলেন কিংবদন্তী। লিলিকে ‘জন অরণ্য’-এ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা গিয়েছিল।
View this post on Instagram
তবে বিয়েটাও হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। লিলির স্বামী অজিত ঘোষ (Ajit Ghosh) কলকাতায় এসেছিলেন সিনেমা পরিচালনার কাজে। লিলিকে তাঁর পছন্দ হয়েছিল। তাঁদের পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি দেখে অজিত, লিলির বাবাকে বলেন, তিনি লিলিকে বিয়ে করতে চান। লিলির বাবা রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। শুধুমাত্র লিলিকে ভালোবেসে বিয়েই করেননি অজিত, তাঁর পরিবারের ভারও নিয়েছিলেন। স্ত্রীর অভিনয়কে আরও পাকাপোক্ত করে তুলেছিলেন তিনি। নিজেই গ্রুম করেছিলেন লিলিকে। তৎকালীন সমাজ ছিল রক্ষণশীল। তা স্পর্শ করতে পারেনি অজিতকে। লিলির স্ক্রিননেম লিলি চক্রবর্তী ছিল এবং এই নামেই তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিয়ের পর অজিত তাঁকে পদবী পাল্টাতে বারণ করেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পদবী পরিবর্তন করলে লিলির কেরিয়ারে প্রভাব পড়তে পারে।
সকালে রুটিন বেঁধে ঘুম থেকে লিলিকে উঠিয়ে ওয়ার্কআউট করাতেন অজিত। নিজে হাতে ফলের রস তৈরি করে খাওয়াতেন। স্ত্রীকে কাঁচা হলুদ ও মুসুর ডাদের রূপটান বানিয়ে দিতেন। প্রকৃতপক্ষে, অজিত সযত্নে লালিত করেছিলেন লিলির প্রতিভাকে। মহানায়ক উত্তম কুমারের স্ত্রীর চরিত্রে একটি ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন লিলি। কিন্তু আচমকা চলে গেলেন উত্তম। ফিল্মটা হল না। লিলি অবশ্য কাউকে দোষ দেন না। তিনি ভাগ্যকে বিশ্বাস করেন। সেই ভাগ্য যা তাঁকে তৎকালীন বম্বের সফল বাঙালি অভিনেত্রীর তকমা দিয়েছিল।
View this post on Instagram
বম্বেতে গিয়েছিলেন ‘সম্পূর্ণ বিষ্ণুপুরাণ’ নামে একটি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করতে। বারবার আসা-যাওয়ার ঝক্কি এড়াতে বম্বেতেই একটি ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে শুরু করেছিলেন লিলি। সেই সময় একদিন তাঁর ফ্ল্যাটে ‘ফুলেশ্বরী’-র স্ক্রিপ্ট শোনাতে আসেন তনুবাবু। সাথে ছিলেন সঙ্গীতকার মুকুল দত্ত (Mukul Dutta)। তিনি তো লিলিকে বম্বেতে থাকতে দেখে অবাক। এক সপ্তাহের মধ্যেই মুকুলবাবুর ড্রাইভার এলেন লিলিকে তাঁর খারের বাড়িতে নিয়ে যেতে। মুকুলবাবুর বাড়িতে গেলেন লিলি। তিনি বললেন, গুলজার (Gulzar) ফোন করেছিলেন। মুকুলবাবু তাঁকে লিলির নাম বলতেই গুলজার জানান, তিনি ‘দেয়া-নেয়া’ দেখেছেন। লিলিকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। লিলির সাথে আলাপ করতে চেয়েছিলেন গুলজার। ওদিকে লিলি দেখেছেন ‘কোশিস’। মুকুলবাবু লিলির আসার খবর জানিয়ে গুলজারকে ফোন করলে তিনি বলেন, সেদিন তাঁর বাড়িতে অনেক অতিথি এসেছেন। লিলি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে তিনি একবার গুলজারের বাড়িতে আসতে পারেন।
View this post on Instagram
মধ্যপ্রদেশে বেড়ে ওঠা লিলির সাবলীল হিন্দি শুনে চমকে গিয়েছিলেন গুলজার। তৈরি হল ‘অচানক’। সুন্দরী বঙ্গতনয়া বম্বের পরিচালকদের নজর কেড়ে নিলেন। ‘অচানক’-এর কিছুদিন পরেই শুরু হল হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় (Hrishikesh Mukherjee) পরিচালিত ফিল্ম ‘চুপকে চুপকে’-এর শুটিং। এরপর ‘আলাপ’ ফিল্মে অভিনয় করলেন লিলি। পরপর তিনটি ফিল্মে অভিনয় করে কলকাতায় ফিরতেই আবারও বম্বে থেকে ফোন। প্রস্তাব এল ‘ইনকার’-এর। পরিচালনা করলেন রাজ.এন.সিপ্পি (Raj N. Sippy)। ‘ইনকার’ -এর শুটিং শেষ করেই আবার লিলিকে ফিরতে হল কলকাতার বুকে। বম্বেতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও লিলি শেষ অবধি বেছে নিলেন বাংলাকেই। বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে ছাড়তে চায়নি। বাংলায় ফিরে না এলে হয়তো আজ সর্বভারতীয় স্তরের অভিনেত্রী রূপে হত তাঁর পরিচয়।
View this post on Instagram
তবু ফিরলেন লিলি। তাঁর প্রাণের শহর কলকাতার বুকে তৈরি ছোট্ট এক ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করতে। বম্বেতে তাবড় নায়িকাদের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন লিলি। কিন্তু বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কি লিলিকে তাঁর যোগ্য চরিত্র দিয়ে সম্মানিত করতে পেরেছে? যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেন বারবার তাঁর কাছে এসেছে পার্শ্ব চরিত্রের প্রস্তাব? লিলি কোনোদিন আক্ষেপ করবেন না। কারণ তিনি শিল্পী। নিংড়ে দিয়েছেন নিজের একশো শতাংশ অভিনয়। আফশোস করা উচিত বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির। তাঁদের রত্নকে বম্বে চিনল, তাঁরা পারলেন না। বিরাশি বছর বয়সেও একই ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন লিলি। কর্মযোগে বিশ্বাসী তিনি। পেরেছেন ভাগ্যকে জয় করে সংসারের দায়িত্ব নিতে। পূর্ণ করেছেন তাঁর কর্মক্ষেত্রকে। লিলি ফুলের মতো সজীব হয়ে ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবক হয়ে রয়েছেন লিলি চক্রবর্তী।
View this post on Instagram