Hoop Special

সোশ্যাল মিডিয়ার জাঁতাকলে হারিয়ে যাচ্ছে ছেলেবেলার সেই ছন্দ মেলানো কবিতা

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ছোট খোকাকে দাঁত ব্রাশ করিয়ে, জল খাইয়ে সহজ পাঠ হাতে ধরিয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তে রান্নাঘর থেকে মায়ের চেঁচিয়ে বলা ‘জোরে জোরে পড়, আমি কিন্তু সব শুনতে পাচ্ছি’। তারপর শুরু হতো খোকার দুলে দুলে কবিতা পড়া। কবিতা মুখস্থ না হলে মাস্টারমশাই ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে শাস্তি দেবেন। এই ভয়েতেই মুখস্থ হয়ে যেত গোটা সহজ পাঠ।

এই দৃশ্যটা যেন মনে হচ্ছে বহুকাল আগে ইতিহাস বইয়ের পাতায় পড়া কোন ঐতিহাসিক ঘটনা। হ্যাঁ, শুনতে বড় খারাপ লাগলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ঘটনা যেন ঐতিহাসিক হয়ে গেছে। কারণ এখন এইভাবে কোন বাড়ির বাচ্চার পড়াশোনা হয় না। প্রত্যেকের বাড়িতে ঢুকে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। কম্পিউটারের হাত ধরে কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের হাত ধরে। কবিতার ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন বেঁধেছে’ আজ মুঠোফোনে বন্দী। মা-বাবারও চূড়ান্ত ব্যস্ত। তাদের নিজেদের সন্তানকে বই পড়িয়ে দেওয়ার সময় নেই। তাই বাধ্য হয়েই সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে তারা নির্ভরশীল। কিন্তু প্রশ্ন এইভাবে কি ছেলেবেলা হারিয়ে যাচ্ছে না? ছেলেবেলার সাথে সাথে ছেলে বেলার কবিতারাও তো হারিয়ে যেতে বসেছে।

সভ্যতা এগোচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এরা কোথায়? ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করার ইঁদুর দৌড়ে বাংলা কবিতা হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে। ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাড়ি’, কিংবা ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর’ হারিয়ে যেতে বসেছে এই সমস্ত কবিতা। কবি জসীমউদ্দীনের লেখা কবর কবিতার দাদু কি আর তার নাতির সঙ্গে সেই ভাবে গল্প করার সময় পাচ্ছেন? না বোধহয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাদু ঠাকুমারা বড্ড একা। কাঁপা কাঁপা হাত গুলো নাতিনাতনীর ছোট্টো ছোট্টো হাত-পাগুলোকে আর পান না। এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলো তখন ব্যস্ত কম্পিউটার বা মুঠোফোনে। স্কুলের বিশাল বিশাল সিলেবাস, প্রজেক্ট বড় হওয়ার এক ইঁদুর দৌড়ে তারা রীতিমতো নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে।

‘নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে’ ছোট ঘর, ভেঙে পড়ছে দরজা-জানলা ছোট্ট পাঠশালার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে মাস্টারমশাই এবং ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চারিত নামতা, কখনো ইতিহাস, কখনো বিজ্ঞান। কিন্তু এখন? এখন তেমন হয় না। ঝাঁ-চকচকে স্কুল কলেজ, শীতল ঘরে সাজানো রয়েছে একটার পর একটা কম্পিউটার অথবা প্রজেক্টর এর সাহায্যে বোঝানো হচ্ছে পড়াশোনা। উন্নতির জন্য এগুলো কি সত্যি প্রয়োজন ছিল? আমেরিকাকে নকল করতে গিয়ে কোথাও কি আমরা আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলছি না? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বিদেশে গিয়ে কয়েক বছর চাকরি করতে গিয়ে যারা বাংলা ভুলে যান, উত্তর দেবে সেই প্রজন্ম।

Related Articles