Hoop Special

শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েও ভেঙে পড়েননি সাহসী সুনীতা, তৈরি করলেন নিজের সংস্থা ‘প্রজ্জ্বলা’

সুনীতা কৃষ্ণন, আজ এই নামটি শুনলেই ধর্ষকরা রীতিমতো ভয়ে কেঁপে ওঠে। কারণটা জানলে সবারই শরীরের প্রত্যেকটা রোম খাড়া হয়ে যাবে। মাত্র ১৫ বছর বয়স, ১৫ বছর বয়সেই যখন ছেলেমেয়েরা শৈশবকাল থেকেই বের হতে পারে না সেই ছোট্ট বয়সেই ৮ জন মিলে ধর্ষণ করেছিল সুনীতাকে। সেই শৈশবকালেই ছারখার হয়ে গিয়েছিল সুনীতার জীবন। গোটা জীবনে অন্তত ১৪ বার শারীরিক নিগ্রহের শিকার হন তিনি। তবে এই কন্যা আর পাঁচটা মেয়ের মতো ছিলনা। ছোটবেলা থেকেই তার মন কেঁদে উঠত অন্যের দুঃখে। নিজে নাচ শেখার পাশাপাশি ছোট ছোট মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নাচ শেখানো শুরু করেছিলেন এতটুকু বয়স থেকেই। বস্তির আর পাঁচটা শিশুদের কষ্ট তাকে বড্ড আঘাত করতে শুরু করলো। বস্তির সমস্ত বাচ্চাদের নিয়ে তিনি তৈরি করলেন বিদ্যালয়।

এতোটুকু একটা মেয়ে প্রতিটা বাচ্চাকে এমন শিক্ষিত করে তুলছে, এ দেখে সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ একটু ভয় পেয়ে গেছিল। কারণ সমাজ যত শিক্ষিত হবে সমাজের অন্যায় তত মানুষের চোখের সামনে প্রকট হয়ে উঠবে এবং মানুষ তত বেশি প্রতিবাদী চরিত্রের হয়ে উঠবে। এই ভয়টাই পেয়েছিল তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই ছোট্ট মেয়ের বিরুদ্ধে সেদিন পুরুষতন্ত্র জোর গলায় চেঁচিয়ে বলেছিল, এই মেয়েকে এমন শিক্ষা দিতে হবে, যাতে সারা জীবন ঘর থেকে বের হতে না পারে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। ওমনি এতোটুকু মেয়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পরলো আটজন মানুষরূপী পশু। মেয়েটির অন্যায় সে আর পাঁচটা সাধারণ ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছে। এই অপরাধে এই স্বাধীনচেতা একরত্তির মেয়েটার উপর একদিনে আটজন পুরুষ মিলে ধর্ষণ করলো ক্রমাগত। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল তার ফুলের মতন শরীর। শারীরিক মানসিক যন্ত্রণায় সুনীতা আজ বধির। তবে এই সব কিছু করেও তাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা যায়নি। মনের অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে পাথেয় করে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। তথাকথিত পুরুষতন্ত্রের মুখে কালি ছিটিয়ে দিয়ে সুনীতা রাস্তায় নেমে পড়লেন প্রতিবাদ করতে। তার এমন সাহসিকতার সামনে হার মেনে গেল তথাকথিত পুরুষ তন্ত্র। তার বদলে ভয় পেয়ে ধর্ষকরা ঘরের মধ্যে বন্দি হয়েছে। এই সবকিছুর পরেও তিনি ব্যাঙ্গালোরের সেইন্ট জোসেফ কলেজ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানের স্নাতক এবং পরবর্তীকালে ব্যাঙ্গালো থেকে MSW পাস করেন। প্রতিবাদ করতে গেলেই শিক্ষিত হওয়া ভীষণ প্রয়োজন তাই এই কাজটি তিনি আগে করে ফেললেন।

তার পরেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমাজের নারীদের সুরক্ষার জন্য। তবেই সব কিছু করতেই তাকে পেরোতে হয়েছে একেকটা কাঁটাতার। কিন্তু কোনো কিছুতেই তিনি বাধা মনে করেননি। নারীকে তিনি কখনোই পণ্য হতে দেবেন না সেই কারণে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশন এর বিরোধীতা করেন তিনি। অবশেষে তার জেল হয় দু মাসের। জেল থেকে বেরোনোর পরে তার এই কাজের জন্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তার পরিবার। মা-বাবা জায়গা দেননি তাকে। তার এই সমস্ত কৃতকর্মের জন্য বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না এইজন্য একটা সময় পরিবার তার কাছ থেকে মুখ ফেরালো। আশেপাশে কেউ নেই এমনকি মা-বাবাও তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন না। কিন্তু তাতে কি হয়েছে তিনি হলেন অগ্নিকন্যা, ছুটে চলেন একাই। চলে গেলেন হায়দ্রাবাদে। হায়দ্রাবাদে গিয়ে দেখলেন সেই সময় এক নিষিদ্ধ যৌনপল্লী থেকে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তারা কোথায় যাবেন, কিভাবে দিনযাপন করবেন কিছু জানেন না। সেই সমস্ত মানুষদের সামনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন সুনীতা।

পেশা হারানো সেই সমস্ত যৌনকর্মীদের হাতের কাজ শেখানো থেকেই শুরু করে যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য স্কুল তৈরি করা সমস্ত কাজই করলেন একা হাতে। আর তার সমস্ত কাজকর্ম লিখে রাখলেন তার নিজের ব্লগের পাতায়। তার প্রতিটা লেখার আঁচড়ে ফুটে উঠল এক একটা মেয়ের যন্ত্রণার এক একটা ঘটনা। মেয়েদের উপর প্রতিনিয়ত কিভাবে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অত্যাচার হয়ে চলেছে তা ফুটে উঠতে শুরু করল সুনীতার কলমের মাধ্যমে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, কিভাবে একটি চার বছরের কন্যা যাকে বাবা, কাকা, দাদা, খুড়তুতো ভাই এবং প্রতিবেশীরা মিলে ক্রমাগত ধর্ষণ করেছিলেন। তার লেখনীর মাধ্যমে তিনি বারংবার জানিয়েছেন, তিনি কীভাবে পাচারকারীদের আটকে ছিলেন, আর পাচারকারীরা কিভাবে তাদের যৌনশোষণ, যৌনখিদে মেটানোর জন্য মেয়েদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার করে। যতক্ষণ না একটি মেয়ে স্বাভাবিকভাবে স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষের কাছে তার দেহ দিতে বাধ্য হয় ততক্ষণ অব্দি চলতে থাকে মেয়েটির ওপর পাশবিক অত্যাচার। অত্যাচার করতে করতে একদিন সেই মেয়ের মৃত্যু হয় কোন দুরারোগ্য ব্যধিতে নর্দমার পাশে।

এই সমস্ত কিছুর পাশাপাশি সুনীতা তৈরি করেন তার স্বপ্নের প্রকল্প ‘প্রজ্জ্বলা’। এ সংস্থাটি চালানোর জন্য রয়েছে ২০০ জন কর্মী, তারা প্রত্যেকেই বেতনপ্রাপ্ত। শুধুমাত্র সুনীতা একাই কোনরকম বেতন গ্রহণ করেননা। নিঃস্বার্থভাবে করে চলেছেন একটার পর একটা কাজ। তবে অনেকেই ভাবেন তবে তার দিনযাপন হয় কী করে? বই লিখে, নারী পাচারের বিরুদ্ধে কয়েকটা সেমিনার করে যতটুকু আসে তা দিয়ে তার চলে যায়। আর বাকি অর্থ দান করে দেন তার প্রকল্পে। এতকিছু করবেন আর কোনরকম সম্মান পাবেন না তা কি হয়? ২০১৬ সালে ‘পদ্মশ্রী’ পাশাপাশি ঝুলিতে ভরে ননে দেশি- আন্তর্জাতিক পুরস্কার। চোদ্দবার শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েও কোন ভাবে ভেঙে পড়েননি। তিনি সমস্ত বাধাকে পেরিয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। কত মেয়ের জীবনে এনে দিয়েছেন শান্তি। তার এই জীবনকে কুর্নিশ জানাতে হয়।

whatsapp logo