Rekha: রহস্যময়ী নন, এক সাধারণ নারী, তবু কেন এত বিতর্ক রেখাকে ঘিরে!
বান্দ্রার ব্যান্ড স্ট্যান্ডের কাছে অবস্থিত সি ফেসিং ‘বাংলো নং 2’ যেন রহস্যের ধোঁয়াশায় মোড়া। সমুদ্রের দিগন্তরেখায় সূর্যাস্তের আলো কখনও ছুঁয়ে যায় ‘বাংলো নং 2’-এর কর্ত্রীর চোখের তারা। কিন্তু তাঁর জীবন ঘিরে নক্ষত্রের আলো। দক্ষিণ ভারতের মাটির গন্ধ মিশে গেছে বম্বের তারকার ছটায়। ভানুরেখা (Bhanurekha) থেকে রেখা (Rekha) হওয়ার লড়াই এখনও সজীব। সেই লড়াইয়ের পথেই একদিন তিনি হয়েছিলেন এই অভিজাত বাংলোর কর্ত্রী, রেখা। বাংলোর চারপাশে মিডিয়ার আনাগোনা থাকলেও প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। সত্যিই কি রহস্যময়ী রেখা? প্রশ্নের বীজ প্রোথিত রয়েছে বহু বছর আগে দক্ষিণ ভারতের এক মহিলার জীবনে।
View this post on Instagram
সময়টা চল্লিশের দশক। সেই সময় হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী আইনত বিবাহ বিচ্ছেদ হত না। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে পুষ্পাভল্লী (Pushpavalli)-র সাথে বিয়ে হল এক শহুরে আইনজীবী আই.ভি. রঙ্গাচারী (I.V.Rangachari)-র। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন পুষ্পাভল্লী। কিন্তু তাঁর স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত। দুই পুত্রসন্তানকে নিয়ে একরকম ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন পুষ্পাভল্লী। ঠাঁই হল না বাপের বাড়িতে। দুই শিশুসন্তানের খাবার জোগাড় করতে জুনিয়র আর্টিস্টের কাজ শুরু করতে হল তেলেগু সিনেমায়। জুনিয়র আর্টিস্টের কাজ করতে করতেই একসময় ‘এ’ রেটেড সিনেমায় কাজের সুযোগ এল। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে পুষ্পাভল্লী রাজি হলেন। তবে বেশিদিন এই ধরনের কাজ করতে হল না তাঁকে। 1947 সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মিস মালিনী’-তে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করলেন পুষ্পাভল্লী। বিপরীতে নতুন নায়ক, নাম তাঁর জেমিনি গণেশন (Gemini Ganesan)। ফিল্মটি ফ্লপ হল। কিন্তু পুষ্পাভল্লীর জীবনের নায়ক হয়ে গেলেন জেমিনি। পুষ্পাভল্লী তখনও জানেন না, বড় ভুল করে ফেললেন।
View this post on Instagram
জেমিনির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন পুষ্পাভল্লী। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেন একসময়। 1954 সালের 10 ই অক্টোবর জন্ম হল এক কন্যাসন্তানের। কিন্তু তার গায়ের রং কালো। মুখ ফিরিয়ে নিলেন জেমিনি। পঞ্চাশের দশকের দক্ষিণ ভারতে কালো মেয়ের জন্ম দুর্ভাগ্যের প্রতীক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পুষ্পাভল্লী মেয়ের নাম দিলেন ভানুরেখা। তবে জেমিনির শারীরিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে তিনি তখন পরিণত হয়েছেন ছোট মাপের চরিত্রাভিনেত্রীতে। অপরদিকে জেমিনি হয়ে উঠেছেন তারকা। দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হলেন পুষ্পাভল্লী। জন্ম নিল আরেকটি কন্যাসন্তান। নাম হল রাধা (Radha)। ততদিনে জেমিনি গোপনে বিয়ে করেছেন বিখ্যাত দক্ষিণী অভিনেত্রী সাবিত্রী (Sabitri)—কে। সেই সময় হিন্দু বিবাহে দুই স্ত্রী বৈধ ছিল। সাবিত্রী ছিলেন জেমিনির দ্বিতীয় স্ত্রী। পুষ্পাভল্লীর বলার কিছু ছিল না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোনোদিনই জেমিনি তাঁকে বিয়ে করবেন না। একসময় পাকাপাকি ভাবে পুষ্পাভল্লীকে ছেড়ে চলে যান জেমিনি। ততদিনে ভানুরেখা একটু বড় হয়েছেন। পুষ্পাভল্লী দুই মেয়েকে নিয়ে পড়লেন অথৈ জলে। সিনেমার কাজ নেই হাতে, হয়তো বা জেমিনির প্রভাবেই। অবশেষে তিনি বিয়ে করলেন মাদ্রাজের সিনেমাটোগ্রাফার কে.প্রকাশ (K.Prakash)-কে। আইনত নাম পরিবর্তন করে হলেন কে.পুষ্পাভল্লী। স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে আবারও দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকা হলেন পুষ্পাভল্লী। তাঁর লড়াই একরকম এখানেই শেষ। পুষ্পাভল্লীর লড়াইয়ের শেষই ভানুরেখার লড়াইয়ের শুরু।
View this post on Instagram
কালো মেয়েকে দত্তক নিতে চাননি কে.প্রকাশ। ফলে ভানুরেখাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল তার দিদিমার কাছে। ভানুরেখার সঙ্গী হল একটি বড় কালো এলাচ যা তার মায়ের ব্যাগে সবসময়ই থাকত। এলাচের গন্ধেই মাকে খুঁজে নিত ভানুরেখা। তাকে স্কুলে ভর্তির কথা কেউই ভাবেননি। পুষ্পাভল্লী মাঝে মাঝেই আসতেন মেয়েকে দেখতে। মায়ের হাত ধরেই ভানুরেখার প্রবেশ ঘটল তেলেগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। তখন তার বয়স মাত্র চার বছর। 1958 সালে ‘ইন্টি গুট্টু’ নামে একটি তেলেগু ফিল্মের মাধ্যমে শিশুশিল্পী হিসাবে অভিনয় শুরু করেন ভানুরেখা। তবে শৈশবে মাত্র দুটি সিনেমায় অভিনয় করতে পেরেছিল ভানুরেখা। শৈশবে ছাড় পেলেও বয়ঃসন্ধিতে নিজের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা ভানুরেখাকে নিজেকেই করতে হল।
View this post on Instagram
নায়িকা হিসাবে 1969 সালে কন্নড় ফিল্ম ‘অপারেশন জ্যাকপট নল্লি সি.আই.ডি. 999’-এর মাধ্যমে ভানুরেখার আত্মপ্রকাশ ঘটে। 1970 সালে বম্বের মাটিতে ভানুরেখা পরিণত হলেন রেখায়। মুক্তি পেল তাঁর প্রথম হিন্দি ফিল্ম ‘সাওন ভাদোঁ’। কিন্তু বম্বেতেও তখন ফর্সা রঙের চাহিদা। ত্বকের রং কালো হওয়ার কারণে রেখাকে শুনতে হত কটাক্ষ। মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলেন তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে রেখা জানিয়েছেন, তিনি নিজেও কোনোদিন ভাবতে পারেননি, তাঁকে বলা হবে ‘সুন্দরী’। ত্বকের নিয়মিত যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সঠিক ডায়েট অনুসরণ করতে শুরু করলেন রেখা। অনেকে বলেন, তিনি প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন। কিন্তু তার সঠিক তথ্যপ্রমাণ কেউই দিতে পারেননি। 1978 সালে ‘ঘর’ ও ‘মুকদ্দর কা সিকন্দর’-এর পর রেখাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরিচালকদের চোখে তিনিই তখন এক নম্বর নায়িকা। এতদিন রেখা চুপ ছিলেন পিতৃপরিচয় নিয়ে। এবার একটি সাক্ষাৎকারে নিস্তব্ধতা ভেঙে জানালেন, তাঁর পিতার নাম জেমিনি গণেশন। বিনা মেঘে বজ্রপাত হল দক্ষিণ ভারতে। উপেক্ষিতা কন্যার পরিচয়ে পরিচিতি হল জেমিনির।
View this post on Instagram
শৈশব থেকে সংসার ভাঙতে দেখেছেন রেখা। পিতা অস্বীকার করেছেন তাঁকে। মা দ্বিতীয় বিয়ে করে সরে গিয়েছেন। অন্নসংস্থানের পথে শৈশবেই হাতেখড়ি। একটু বিশ্রাম চেয়েছিলেন রেখা। বিয়ে করে সংসার করতে চেয়েছিলেন। মা হতে চেয়েছিলেন। 1990 সালে প্রায় হঠাৎই রেখা বিয়ে করলেন দিল্লীর বাসিন্দা শিল্পপতি মুকেশ আগরওয়াল (Mukesh Aggarwal)-কে। সেই সময় ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলিতে প্রায়ই ছাপা হত মুকেশ ও রেখার ঘনিষ্ঠ ছবি। হাসিমুখে মুকেশকে জড়িয়ে ধরেছেন রেখা। আর পাঁচজন সাধারণ নারীর মতোই মুকেশের কাছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েও সংসার বাঁচাতে চেয়েছিলেন রেখা। তাই মুখের হাসি দিয়ে মিডিয়ার সামনে ঢেকে রাখতেন ভিতরের দুঃখ। বিয়ের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে মুকেশ আত্মহত্যা করেন। রেখে যান একটি সুইসাইড নোট যাতে লেখা ছিল তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আসলে মুকেশ ছিলেন স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী। এর আগেও তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকে রক্ষা করেছিলেন রেখা। কিন্তু শেষযক্ষা হল না। কারণ রেখা সেই সময় লন্ডনে ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দ্রুত ভারতে ফিরে এলেন সদ্যবিধবা। সমাজ এবার কালো মেয়েকে দাগিয়ে দিল ‘খুনি ডাইনি’ বলে।
View this post on Instagram
সামলালেন রেখার হেয়ার ড্রেসার ফারজানা (Farzana)। ফারজানা বরাবর পুরুষের পোশাকেই সজ্জিত থাকতেন। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত রেখার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে কাঁধে মাথা রেখে কাঁদার সুযোগ দিয়েছিলেন ফারজানা। ইন্ডাস্ট্রির কেউই সেদিন এগিয়ে আসেননি রেখার সমর্থনে। পরিবারও ভয় পেয়েছিল রেখাকে সমর্থন করতে। ফারজানাই রেখাকে ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদ থেকে বার করে এনেছিলেন। ততদিনে তিনি রেখার সেক্রেটারি। তবে তা মুখেই। প্রকৃতপক্ষে রেখার প্রিয় বান্ধবী তিনি। কিন্তু সেই সম্পর্ককে কলুষিত করলেন লেখক মোহনদীপ (Mohandeep)। তাঁর লেখা বই ‘ইউরেকা’-য় মোহনদীপ লিখলেন, রেখা বাইসেক্সুয়াল। ফারজানার সাথে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। বইটির পাবলিশিং হাউস ও স্থানীয় বুকস্টোরে ছুটে গিয়েছিলেন রেখা। অনুরোধ করেছিলেন ‘ইউরেকা’ না রাখতে। কিন্তু তাঁর সেই অনুরোধ গ্রাহ্য হয়নি। সাক্ষাৎকারে রেখা বারবার বলেছেন, মোহনদীপ পরিবেশিত তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। শুধুমাত্র বই বিক্রির কারণে মোহনদীপ ব্যবহার করেছিলেন রেখার ব্যক্তিগত জীবনকে। কিন্তু তিনি যা লিখেছিলেন তা ছিল ভিত্তিহীন। কিন্তু মোহনদীপ জানতেন, রেখার রহস্যময় জীবনযাত্রা নিয়ে অধিকাংশ মানুষের প্রশ্ন রয়েছে। তাঁদের কাছে ‘ইউরেকা’ গ্রহণযোগ্য হবে। এবার রেখার ভাগ্যে জুটল ‘বাইসেক্সুয়াল’ তকমা।
View this post on Instagram
আর কত? ‘কালো মেয়ে’, ‘খুনি ডাইনি’, ‘বাইসেক্সুয়াল’ ও আরও না জানি কত ধরনের তকমা। এক নারী নিজের মতো করে বাঁচতে চান। অবসর সময় কাটান তাঁর সন্তানসম সারমেয়দের সাথে। প্রতিদিন সকালে নিজের হাতে পরিচর্যা করেন গাছের। রেখা নিরামিষাশী। তাই নিজের হাতেই রান্না করে নেন নিজের খাবার। বাড়ি ও সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ফারজানাকে বিশ্বাস করে দিয়েছেন তিনি। সকলের প্রশ্ন, শুধুমাত্র ফারজানাই কেন অনুমতি পেয়েছেন রেখার বেডরুমে প্রবেশ করার! একবার নিজেদেরকে এই প্রশ্ন করে দেখা উচিত। বেডরুম অত্যন্ত ব্যক্তিগত স্থান। প্রাচীন কাল থেকেই মহিলারা তাঁদের শোবার ঘরকেই বেছে নেন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য। বর্তমানে একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও কোনো জরুরী আলোচনা থাকলে বাড়ির সদস্যরা বেডরুমে জমায়েত হন। এটি অত্যন্ত সাধারণ দৃশ্য। রেখার জীবনে তাঁর বান্ধবী, বোন ও পরিবার সবই তো ফারজানা। তাহলে রেখা কেন ফারজানার সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য বেছে নেবেন না বেডরুমকে?
View this post on Instagram
রেখা এক সাধারণ নারী। মাতৃস্নেহে পরিপূর্ণা। কিন্তু সমাজ তাঁকে বানিয়ে দিয়েছে রহস্যময়ী। তাঁর যৌনতা নিয়ে তুলেছে প্রশ্ন। আটষট্টি বছর বয়স পেরিয়ে আর কত সহ্য করবেন রেখা? কত লড়াই করবেন সমাজের বিরুদ্ধে? তাই সমঝোতা করে নিয়েছেন তিনি। মাথা পেতে সব দোষ নিয়ে নিজেকে সাধারণ নারী থেকে রহস্যময়ী তারকা হয়ে উঠতে দিয়েছেন তিনি। এটাই হয়তো ছিল ভানুরেখার ভবিতব্য!
View this post on Instagram