আমার জন্য অপেক্ষা করো: ইরফান খান
“প্রবাদ আছে, যখন জীবন তোমার হাতে লেবু ধরিয়ে দেয়, তুমি তা দিয়ে লেমোনেড বানিয়ে নাও, বলতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু সত্যিই যখন জীবন তোমার হাতে লেবু ধরিয়ে দেয়, তখন শিকঞ্জি বানানো মুশকিল হয়ে যায়”। হাসতে হাসতে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এই বার্তাই দিয়েছিলেন ইরফান (Irrfan Khan)। নিজেই বলেছিলেন, আর কোনো অপশন নেই। তাঁর শরীরে বিশেষ কিছু অতিথি বাসা বেঁধেছে। সেই অতিথির ডাকেই 2020 সালে আচমকাই চলে গেলেন ইরফান। সত্যিই কি চলে গেলেন?
View this post on Instagram
না, শিল্পীর মৃত্যু হয় না। শরীরটা দাফন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তবু বেঁচে রয়েছে অনেক আশা, ইরফানের সৃষ্টির মধ্যে। বলিউডে তথাকথিত পেশিবহুল, রোম্যান্টিক নায়কোচিত চেহারা ছিল না ইরফানের। কিন্তু ছিল দুটি অমোঘ চোখের দৃষ্টি যা স্বপ্ন দেখতে জানত। সেই স্বপ্নের তাগিদেই রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় অ্যাডমিশন নিয়েছিলেন ইরফান। পিছনে ফেলে রেখে এসেছিলেন অনূর্ধ্ব একুশ ক্রিকেট খেলোয়াড়ের উজ্জ্বল জীবন। এন.এস.ডি-র থিয়েটারে প্রশংসিত হত তাঁর অভিনয়। কিন্তু অত্যন্ত রোগা ছেলেটি বলিউডের সফল অভিনেতা হবেন, এই দুরাশা ছিল না কারো মধ্যেই। শুধু স্বপ্নটা দেখতেন ইরফান।
View this post on Instagram
স্বপ্ন পূরণ করতে আসতেই হত মুম্বই। কিন্তু হাতে নেই একটি পয়সাও। অবশেষে একরকম বাধ্য হয়েই এয়ার কন্ডিশনার সারানোর কাজ নিয়ে মুম্বইয়ের মাটিতে পা রাখলেন ইরফান। এয়ার কন্ডিশনার সারানোর পাশাপাশি স্টুডিওতে ছবি জমা দিতে শুরু করলেন তিনি। বারবার অডিশনে রিজেকশন, কিন্তু চিড় খায়নি স্বপ্ন। আশির দশকে তখন কমার্শিয়াল ফিল্মের নায়করা বলিউড কাঁপাচ্ছেন। ঘটনাচক্রে, একদিন রাজেশ খান্না (Rajesh Khanna)-র বাড়িতে এয়ার কন্ডিশনার সারানোর ডাক পড়ল। ইরফান সেদিন এয়ার কন্ডিশনার যত না সারিয়েছিলেন, তার থেকেও বেশি অনুভব করেছিলেন রাজেশের স্টারডমকে। বুঝেছিলেন, উচ্চতায় উঠলেও ডাউন টু আর্থ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই অনুভূতি তাঁকে ইউফোরিয়ার বাসিন্দা হতে দেয়নি কোনোদিন। যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘সালাম বম্বে’ ফিল্মে একটি অত্যন্ত ছোট চরিত্র দিয়ে। কিন্তু স্বল্প সময়েই মনে দাগ কেটে গিয়েছিলেন ইরফান। কিন্তু এরপরেও ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ আসত না। থেমে থাকার পাত্র ছিলেন না ইরফান। টেলিভিশনে একের পর এক সিরিয়াল,টেলিফিল্মের পাশাপাশি থিয়েটারে অভিনয় করতে শুরু করলেন। হঠাৎই আবারও ফিল্মে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় শুরু। ফিরিয়ে দিলেন না ইরফান। তিনি জানতেন, শিল্পীর শিল্প চিরসত্য। ইরফানের স্বপ্ন টনক নড়িয়ে দিল তথাকথিত ‘মাচো’ বলিউডের।
View this post on Instagram
2005 সালে হিন্দি ফিল্ম ‘রোগ’-এ প্রথম নায়কের চরিত্রে অভিনয় চমকে দিয়েছিল ফিল্ম ক্রিটিকদের। তাঁরা মুখোমুখি হয়েছিলেন এক অন্য ধরনের নায়কের যার আটপৌরে চেহারার দুই চোখ কথা বলে অবিরত। শুরু হল ইরফান যুগ। এরপর একের পর এক ফিল্মে অভিনয় করেছেন ইরফান। বাদ যায়নি তেলেগু ও ইংরাজি ভাষার ফিল্মও। প্রতিটি চরিত্র একে অপরের থেকে আলাদা। বারবার ভেঙেছেন নিজেকে, গড়ে উঠেছে কালজয়ী চরিত্র। অন্য ধারার ফিল্ম কমার্শিয়াল হয়ে উঠেছে ইরফানের স্পর্শে। কমার্শিয়াল ফিল্ম হয়েছে চূড়ান্ত সফল। 2008 সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অস্কারজয়ী ফিল্ম ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে ইরফানকে।
View this post on Instagram
একই সঙ্গে সঞ্চালনা করেছেন টেলিভিশন শো, হয়েছেন ‘রিসারজেন্ট রাজস্থান’-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। স্বপ্নটা সত্যি হবার ছিল। ইরফান প্রমাণ করেছেন, লড়াই সত্য, একইসঙ্গে সত্য স্বপ্নের জয়। কিন্তু বিজয়রথের চাকা হঠাৎই টলিয়ে 2018 সালে টুইটারে নিজেই জানিয়েছিলেন, নিজের মারণ রোগের খবর। অনুরাগীদের একাংশ ভেঙে পড়েছিলেন। বলিউড চমকে গিয়েছিল। ততদিনে ইন্ডাস্ট্রি অনেকটাই ইরফান নির্ভর। ইউকে-তৈ ট্রিটমেন্ট করিয়ে দেশে ফিরেছিলেন ইরফান। অসুস্থ শরীর নিয়ে, শুধুমাত্র মনের জোরে ‘আংরেজি মিডিয়াম’-এর শুটিং শেষ করেছিলেন।
View this post on Instagram
মাঝে মাঝে সুস্থ বোধ করেন, আবারও অসুস্থতার শিকার হন। শেষ অবধি 2020 সালের 28 শে এপ্রিল ভর্তি করতে হল মুম্বইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হসপিটালে। মায়ের হৃদয়ের অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলেন ইরফান। তিরানব্বই বছরের বৃদ্ধা মা সহ্য করতে পারলেন না পুত্রকে হসপিটালের বেডে অচেতন দেখার কষ্ট। পুত্রের মৃত্যুর চারদিন আগে জয়পুরে মৃত্যু হল ইরফানের মা সঈদা বেগম (Saeeda Begum)-এর। ইরফান তখন হসপিটালের বেডে লড়ছেন কোলন ইনফেকশনের সাথে। 29 শে এপ্রিল মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে নিভে গেল জীবনদীপ। গোটা দেশ জুড়ে করোনা অতিমারীর ফলে তখন ঘোষিত হয়েছে লকডাউন। অত্যন্ত সাধারণ ভাবে ইরফানের জানাজা হলেও মিডিয়ায় তাঁর প্রতিটি মুহূর্তের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
View this post on Instagram
অপরদিকে তখন লিউকোমিয়ায আক্রান্ত ঋষি কাপুর (Rishi Kapoor)। সহ্য করতে পারলেন না তাঁর প্রিয় অভিনেতার অকালপ্রয়াণ। ইরফানের মৃত্যুর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীকে ‘আলবিদা’ জানালেন ঋষি। ইরফানের মৃত্যুর পর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছিল ‘আংরেজি মিডিয়াম’, তাঁর অভিনীত শেষ ফিল্ম। ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও তা চিরস্মরণীয়। তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন ইরফান। কবরের মাটি আজ ভিজিয়ে দেয় বৃষ্টি, সোনালি রোদে মাখামাখি হয়ে যায় চারিদিক। দিন কেটে যায়, অনন্ত অপেক্ষায় আজও ইরফানের রেখে যাওয়া পৃথিবী। আজ, 7 ই জানুয়ারি, ইরফানের জন্মবার্ষিকী। সত্যিই কি সব কিছু শেষ হয়ে গেছে, নাকি এক নতুন শুরুর প্রতীক্ষায়?