গানে-লয়ে-কবিতায় স্বামী বিবেকানন্দ, জন্মদিনে প্রকৃত প্রেমিকের গল্প গাঁথা
কি বলা যায় তাঁকে? হিন্দু সন্ন্যাসী নাকি দার্শনিক নাকি ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য? পরিচয় তাঁর অনেক, মেধা তাঁর অসীম, দূরদৃষ্টি তাঁর প্রখর, বুদ্ধি তাঁর চিরন্তন, তিনি আজও নবীন, আজও প্রবীণ। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও এই মানুষটি জীবন্ত। মনে হয় যাকে ডাকলে আনন্দ অশ্রু আসে, যাকে প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছে করে আর যাকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে – তিনি হলেন মানব রুপী ‘শিব‘।
উত্তর কলকাতার সিমলা স্ট্রীটের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জম্ন হয়েছিল তাঁর। ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের দিন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি। বাড়ির নাম ছিল ‘বিলে‘। এই বিলে প্রথম তাঁর মায়ের কাছে শেখেন বাংলা বর্ণমালা, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প মায়ের মুখে শোনা। একবার এই খুদে বিলের মা বলেছিলেন “আমি শিবের মত একটা ছেলে চাইলাম, আর শিব নিজে না এসে একটা ভূতকে পাঠিয়ে দিলেন।”
ছোট্ট বিলে যেমন বাংলা সাহিত্যে অপার বিদ্যা অর্জন করেছিলেন তেমনই বিদেশী ভাষাও রপ্ত করেছিলেন, জানতেন বিভিন্ন ধরণের রান্না, এমনকি তলোয়ার চালানো, লাঠিখেলা, নৌকা চালানো- সবই তাঁর নখদর্পণে। সব থেকে বিস্ময়কর ব্যপার হল এই মানুষটি অন্যের মস্তিস্ক থেকে শব্দজাল তুলে নিতে পারতেন। হ্যাঁ, তাঁর বোধশক্তি এবং অভিজ্ঞতা এতটাই প্রবল যে তিনিই প্রথম যোগী যিনি ইউরোপে গিয়ে একজন জার্মান দার্শনিকের মুখোমুখি হন এবং সেখানে গিয়ে অদ্ভুত এক ব্যপারের সম্মুখীন হন। সেদিন রাতের খাবার শেষ করে ওই জার্মান দার্শনিকের সঙ্গে গল্পে বসেছিলেন, সেদিন একটা বড় বই টেবিলে রাখা ছিল, যেই বইটার আনুমানিক পাতার সংখ্যা ৭০০। ওই জার্মান দার্শনিক ওই ৭০০ পাতার বইটি নিয়ে খুব উচ্চ ধারণা নিয়ে কথা বলছিলেন, ঠিক তখন বিবেকানন্দ ওই ভদ্রলোকের থেকে বইটি চাইলেন মাত্র ১ ঘন্টার জন্য। সেই ভদ্রলোক হেসে উঠে বললেন আপনি ১ ঘন্টার মধ্যে এই বই শেষ করতে পারবেন? আমি প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে বইটি পড়ে চলেছি এবং এখনও কোথাও পৌঁছতে পারিনি কারণ এটা এতটাই জটিল। তারমধ্যে আপনি জার্মান ভাষা জানেন না তাহলে ১ ঘন্টার মধ্যে কীভাবে পড়বেন? তাও বিবাকানন্দ চাইলেন এবং ওই ভদ্রলোক তা দিলেন। বিবেকানন্দ বইটি নিয়ে দুহাতের মধ্যে রেখে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন এবং ১ ঘন্টা পর তিনি ওই বইটি ফেরত দিয়ে বললেন এটার মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সেরকম কিছু নেই। সেই ভদ্রলোক ভাবলেন এটা তো ঔদ্ধত্যের চূড়ান্ত। আপনি বইটি খুললেন না এমনকি একটা পাতাও উল্টে দেখলেন না অথচ আপনি মন্তব্য করলেন? সেদিন ওই ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে শুধু বলেছিলেন একি আজেবাজে কথা। তখন বিবেকানন্দ হালকা হেসে বললেন আপনি আমাকে এই বই থেকে যা কিছু জিজ্ঞাসা করুন আমি আপনাকে বলে দেব। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করে বললেন, ঠিক আছে ৬৩৩ পাতায় কি আছে? সেদিন বিবেকানন্দ অক্ষরে অক্ষরে সবটা বলে দিলেন। তখন ওই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন এটা কেমন করে? আপনি তো বই খুলেও দেখেননি! তখন স্বামজী উত্তর দিয়েছিলেন সেই জন্য আমাকে সবাই বিবেকানন্দ বলে। কারণ ‘বিবেক’ মানে বোধশক্তি। আসল নাম তাঁর নরেন্দ্র, কিন্তু রামকৃষ্ণ তাঁর নামকরণ করেছিলেন ‘বিবেকানন্দ‘ দিয়ে।
এই গুরুর প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ‘প্রেম’। যেই প্রেম শব্দ-লয়-ছন্দ-সুর দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলেন স্বামীজি। লিখেছিলেন –
খণ্ডন ভব বন্ধন জগ বন্দন বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন নর-রূপ-ধর নির্গুণ গুণময়॥
মোচন অঘদূষণ জগভূষণ চিদ্ঘনকায়।
জ্ঞানাঞ্জন-বিমল-নয়ন বীক্ষণে মোহ জায়॥
ভাস্বর ভাব-সাগর চির-উন্মদ প্রেম-পাথার।
আজও এই ভক্তের গান দিয়ে পূজা করা হয় রামকৃষ্ণকে বেলুড় মঠে। হ্যাঁ, বিবেকানন্দ ছিলেন সংগীতজ্ঞ ও গায়ক। তার রচিত আরও একটি বিখ্যাত গান হল –
নাহি সূর্য নাহি জ্যোতিঃ নাহি শশাঙ্ক সুন্দর।
ভাসে ব্যোমে ছায়া-সম ছবি বিশ্ব-চরাচর॥
অস্ফুট মন আকাশে, জগত সংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডুবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর॥
শুধু গান নয়, কবিতাতেও তাঁর ছিল বোধ। লিখেছিলেন- “নাচুক তাহাতে শ্যামা”, “৪ জুলাইয়ের প্রতি”, “সন্ন্যাসীর গীতি” ও “সখার প্রতি”। এই ‘সখার প্রতি’ কবিতার সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতি হল –
“বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? / জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”