Tourism: ভূত চতুর্দশীর রাতে অন্যরকম অভিজ্ঞতা পেতে নিরিবিলি এই স্থানে ঘুরে আসুন, গা ছমছম করতে বাধ্য
পাহাড়ে যেতে পছন্দ করেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কংক্রিটের জঙ্গল থেকে যখন মনে হয় ছুট্টে বেরিয়ে যাব, তখন কিন্তু আকাশছোঁয়া পাহাড় আপনাকে সত্যি সত্যিই অনেকটা শান্তি দিতে পারবে, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আপনার মন কোথায় যেন হারিয়ে যাবে। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছা করবে –
‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না।’
কবির কল্পনায় চলে গিয়ে সত্যি সত্যি একটা পাহাড় কেনা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছুদিনের জন্য যদি আপনি পাহাড়টাকে সাক্ষী রেখে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চান, তাহলে চলে যেতেই পারেন কালিম্পংয়ের একটি অফবিট ডেস্টিনেশনে। কালীপুজোর লম্বা ছুটিতে উপযুক্ত ভ্রমণ স্পট হতে পারে কালিম্পংয়ের একটি ভুতুড়ে গেস্ট হাউস, যার নাম মর্গান হাউস। ভূত চতুর্দশীর রাতে গা ছমছমে অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে চাইলে স্থান আপনার জন্য একেবারে উপযুক্ত।
কালিম্পং-এর নাম শুনলেই মনে হয় বড্ড ঘিঞ্জি পরিবেশ, আবার কেন সেখানে যাব? কিন্তু এটা কালিম্পং থেকে একটু দূরে একটি অফবিট ডেস্টিনেশন। জায়গাটি কিন্তু বেশ ফাঁকা, অমাবস্যার রাতে গা ছমছম করবেই। সত্যি সত্যি তেঁনাদের দেখা পেতে একবার আপনাকে যেতেই হবে সেই মর্গান হাউস, হয়তো কোনো রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন। এটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি, যার পেছনে রয়েছে নানান রকম ঐতিহাসিক ঘটনা এবং রহস্য। কালীপুজোর সময় অমাবস্যার অন্ধকারে এমন মিশকালো রহস্য ভেদ করতে বা গা শিউরে ওঠা অভিজ্ঞতা পেতে ঘুরে আসতে ইচ্ছে হবে মর্গান গেস্ট হাউসে।
এই ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯৩০ সালে। এক নীলকর সাহেবের মেয়ের সাথে পাটের ব্যবসায়ী জর্জ মর্গানের বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এই বিশাল বাড়ি। বিদেশি সাহেব প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশাপাশি এমন অসাধারণ ভবনটির। তাই গ্রীষ্মকাল তো বটেই প্রায় সারাবছরই থাকতে শুরু করলেন দুজনে। পরে মিঃ এবং মিসেস মর্গান মারা যাওয়ার পর বাড়িটি এমনিই পড়েছিল হন্টেড হাউসের মতোই। পরে স্বাধীনতার পর বাড়িটির মালিকানা ভারত সরকারের হাতে চলে আসে। বর্তমানে দুরপিন্দারা পাহাড়ের উপরে ষোল একর এস্টেটে অবস্থিত প্রাসাদটি পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন কর্পোরেশন দ্বারা পরিচালিত একটি হোটেল। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল এই বাংলো। হোটেলের আশেপাশে বেরোলেই দেখতে পাবেন অসাধারণ কাঞ্চনজঙ্ঘা। মেঘ-পাহাড়ের অদ্ভুত লুকোচুরি দেখে আপনি মনে মনে বলে উঠবেন –
‘সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে,
‘আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।’
মেঘ পাহাড়কে বললে,
‘আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।’
পাইন, ওক, রডোডেনড্রন এর জঙ্গলে চন্দন কাঠ খুঁজে পাওয়া বিরল। তবে কবির কল্পনায় পাহাড়কে চন্দন জলে স্নান করানোর পরে যে স্বর্গীয় অনুভূতি হয়, কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে আপনিও সেই স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করতে পারবেন, যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। তবে শুধু সাধারণ পর্যটক নয়, তারকাদেরও পছন্দের জায়গা এটি। উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া দেবী, কিশোর কুমার, অমিত কুমার, লীনা চন্দ্রভরকার, সুনীল দত্ত, নার্গিস, ওম প্রকাশ কোনও একটি সিনেমার শুটিংয়ের সময় এখানে দীর্ঘ কয়েকমাস ছিলেন। উৎপল দত্তের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা মর্গান হাউস।
মনে খানিকটা সাহস নিয়ে বাংলোয় প্রবেশ করার আগে বাংলোর সামনে অসাধারণ সবুজে ঘেরা লনে দু’দণ্ড বসে যেতে পারেন। পায়ের নীচে সবুজ ঘাস, আর সামনের দিকে অসাধারণ পাহাড়ি পরিবেশ আর মাথার উপরে নীল আকাশ মন থেকে ভয়কে দূর করিয়ে দেবে। বাইরে থেকে গেস্টহাউসটা দেখলে মনে হবে সত্যিই কোন ভুতুড়ে বাড়ি। গেস্ট হাউজের দেওয়ালের উপরে জমে গেছে শ্যাওলা সবুজ ঘাসের আস্তরন, কিন্তু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আপনি বুঝতে পারবেন না কোনো ফাইভ স্টার হোটেল না সত্যিসত্যিই গেস্ট হাউসে রয়েছেন। সুন্দর ঝাঁ-চকচকে কাঠের মেঝে, কাঠের ফার্নিচার, ফায়ারপ্লেস যাকে বলে একেবারে রাজকীয় আদব-কায়দা।
এতটা পড়ে নিশ্চয়ই আপনার মনে একটা খটকা লাগছে, বাংলোটা যখন এত সুন্দর তাহলে এই বাংলোকে ভুতুড়ে বলা হচ্ছে কেন? ঠিক কথা। এই সবই তো গেল দিনের আলোর ঘটনা। রাত বাড়লেই নাকি তেঁনাদের উৎপাত শুরু হয়। এমনটাই সেখানকার আশপাশের বাসিন্দাদের মত। মর্গান এর স্ত্রী ভীষণ ভালবাসতেন এই ভবন। তার মৃত্যুর পরও শোনা যায়, এই বাড়িতেই নাকি তিনি ঘুরপাক খান। অতিথিরা ঠিক মতন যত্ন পাচ্ছেন কিনা সেটা ঘুরে ঘুরে দেখেন তিনি। তবে মর্গান সাহেবের স্ত্রী কারোর কোনো ক্ষতি করেন না। লোকমুখে শোনা যায়, পূর্ণিমার রাতে নাকি তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। কালীপুজোর এমন অমাবস্যার মিশকালো অন্ধকারে বেড়াতে গেলে তাকে দেখতে পাবেন কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না।
তবে অনেকেই বলেছেন, এই ভূতুড়ে গল্প হল সবই রটনা। রাতের অন্ধকারে এই গেস্ট হাউসে রাত কাটানোর একটা আলাদা মজা রয়েছে। সকাল হলেই গেস্ট হাউস থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে দেখে আসতে পারেন আর্মি এলাকাগুলিতে। যানজট নেই, কোনো পরিবেশ দূষণও নেই, ঝাঁ-চকচকে রাস্তায় আকাশ, গাছপালা সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নময় পরিবেশ।
কালিম্পং হল অর্কিডের দেশ ভারত ও তিব্বতের মধ্যে একটি প্রাচীন বাণিজ্য প্রবেশদ্বার। ঘন পাইন বন, অর্কিড এবং উপত্যকার মধ্য দিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারবেন। একেবার গাড়ি ভাড়া করে বোঁ করে ঘুরে আসতে পারেন কালিম্পং এর বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে। দেখার জায়গাগুলি হল – কালিম্পং আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট সেন্টার, থার্পা চোলিং মঠ, থংসা (ভুটান) মঠ, দুরপিনদানরা যেখান থেকে জেলেপলা, টাইগার হিল সহ সিকিমের পর্বত এবং রেলি, রিয়াং এবং তিস্তা নদীর সঙ্গম দেখা যায়। দুরপিনদানরার জং-ডগ-পালরি-ফো-ব্রাং মঠ, চমৎকার দৃশ্যের জন্য দেওলো ভিউ পয়েন্ট, এবং কালিম্পং বিখ্যাত ফুলের নার্সারি।
চলুন দেখে নিন কিভাবে যাবেন অসাধারণ এই ডেস্টিনেশনে –
আকাশপথে – কালিম্পং এর কাছাকাছি এয়ারপোর্টে হল বাগডোগরা। বাগডোগরা থেকে সহজেই নিউ দিল্লী, কলকাতা, গৌহাটিতে যাওয়া যেতে পারে। বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে খুব সহজেই গাড়িতে করে পৌঁছে যেতে পারেন কালিম্পং।
ট্রেন পথে – কালিম্পং এর কাছাকাছি রেলওয়ে স্টেশন দুইটি হল শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়ি।
সড়কপথে – শিলিগুড়ি থেকে খুব সহজেই গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারবেন কালিম্পং।
তাহলে আর কি এবার ব্যাগপত্র গুছিয়ে এই দীপাবলির ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন মর্গান হাউস। পাহাড়, রহস্য, শান্ত পরিবেশ, পাইন গাছের জঙ্গল সব মিলিয়ে স্মৃতির ভান্ডারটা বেশ খানিকটা পূর্ণ হবে, এ কথা বলা যেতে পারে।