বদলে গেছে দিনকাল, নেই সেই আনন্দ, চলুন ফিরে দেখি ছোটবেলার দুর্গাপুজোর স্মৃতি
‘ওও…ও আয়রে ছুটে আয়, পুজোর গন্ধ এসেছে, ঢ্যাং কুরাকুর ঢ্যাং কুরাকুর বাদ্যি বেজেছে, অন্তরা চৌধুরীর সেই বিখ্যাত গান, এই গানটির সাথে সাথে পুজোও আসতো আমাদের ঘরে। পুজোর আগেই মহালয়ার দিন, ঘুম ভাঙতে ইচ্ছা না করলেও মা-বাবা, দাদু ঠাকুমা ভোর বেলাই পুরনো রেডিওটা ঝেড়ে পুছে পরিষ্কার করে তার কান মুলে দিয়ে জোরে চালিয়ে দিতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া। অনেকটা ওই ঘাড় ধরে শোনানোর মত। মহালয়ার শেষে বাড়ি পুরুষদের তর্পণ করতে যাবার পালা। বাবার একদিন অফিসে ছুটি নিয়ে অথবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে পাড়ার কাছাকাছি দোকান থেকেই মায়ের জন্য ঠাকুর মার জন্য, পিসিদের জন্য জামা কাপড় কেনা। সবশেষে মায়ের কেনাকাটার লিস্ট থাকতো সিঁদুর, আলতা, টিপ, কুমকুম, স্নো আরো টুকিটাকি জিনিস। তবে বাবাদের প্রয়োজনটা খুবই কম, তাদের সারা বছরের দু-একটা জামাকাপড়ে দিব্যি চলে যায়।
সারা বছর ধরে এই চারটি দিনের জন্য অপেক্ষা করা। চারটি দিনের চারটি ভালো ভালো জামা কাপড়, পরিবারের সকলের সঙ্গে হইহই করে ঠাকুর দেখা। নতুন জামাকাপড়, হোক না কমদামি কিন্তু ছোটবেলায় এই জামা কাপড়গুলোই ছিল বুক ভর্তি অক্সিজেনের মতন। এই চারটি দিনের জন্য খাতা বইকে একেবারেই শিকেয় তুলে দিয়ে শুধুই আনন্দ। পুজোর দু’একদিন আগে বাবা সেলুনে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসতেন বাটি ছাঁট আর মেয়ে হলে, মাথায় বেশ করে টক দই আর ডিম লাগিয়ে চলত আধুনিক যুগের হেয়ার স্পা। পুজোর সময় খবর কাগজ কাকুকে বলা থাকতো পুজো সংখ্যার বইপত্র গুলো কিন্তু ঠিক সময় যেন বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আর ভীষণ আনন্দ করতে করতে পুজোর চার দিন কেটে যেত। পঞ্চমীর দিন রঙিন ড্রেসে স্কুলে যেতে হতো। তাই মোটামুটি পঞ্চমী থেকেই শুরু হয়ে যেত পুজোর আমেজ। দামি দামি রেস্টুরেন্টের থেকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চাওমিন এগ রোল খাওয়ার মধ্যে ছিল এক নিপাট আনন্দ। হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখার পর নতুন জুতো পরে পায়ে ফোসকা পরা ছিল একেবারে অবধারিত ঘটনা।
পুজোর আগেই নতুন নতুন জামাকাপড়গুলো পরে মা-বাবার সামনে দু-একবার ঘুরপাক খাওয়া হয়ে যেতো। মাঝে মধ্যে নতুন জামার গন্ধ শুঁকেই বুক ভরা অক্সিজেন গ্রহণ করা যেত। আবার প্যাকেট বন্দি করে যত্ন করে তুলে রাখা বিশেষ দিনের জন্য। ছেলে হলে অষ্টমীর দিনে অঞ্জলি দিতে গেলে অবশ্যই থাকত পাঞ্জাবি আর মেয়ে হলে মায়েদের শাড়ি নিয়ে টানাটানি। নব্বইয়ের পুজোর মধ্যে আরেকটি জিনিস বেশ মজাদার ছিল। তা ছিল পুজো প্রেম। পাড়ার যে দাদা বিদেশে পড়াশোনা করবে বলে সে শুধু স্বপ্নের নায়ক হয়ে থেকেই গিয়েছিল, পুজোর চার দিন তাকে প্রাণ ভরে দেখে নেওয়া, অথবা হিটলার মা-বাবার জন্য যে মেয়েটির নাগাল পাওয়া যায়নি, পুজোর চারদিন তার পাশে দাঁড়িয়ে একটু অঞ্জলি দেওয়া, এর মধ্যেই প্রেমকে খুঁজে নিত সে যুগের যুবক-যুবতীরা। দশমীতে মায়ের যাওয়ার পালা। দশমীতে শুরু হয় বাড়িতে বাড়িতে নিমকি বানানো, ঘুগনি বানানোর বা নাড়ু বানানোর প্রস্তুতি। প্রনাম,কোলাকুলি পর্ব চলার পরে চলত বিশাল রকমের পেটপুজো।
এ তো গেল সেকালের কথা। সেকালের সঙ্গে একালের বিচার করলে চোখ ফেটে জল আসে। এখন থিমের পুজো হয়েছে। নানান রকম থিম এর উপরে ভিত্তি করে পুজো হয় ডাকের সাজ আর দেখা যায়না। পাড়ার ‘অমুক’ শাড়ি স্টোর্স আজ বসে বসে মাছি তাড়াচ্ছে শপিংমলে দৌরাত্ম্যে। পুজোর চারটে দিন জামাকাপড় তো হয় সেটা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু এখন আর সেই জামাকাপড় জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, এখন সারা বছর ধরেই ওয়ারড্রব ভর্তি থাকে দামি দামি জামা কাপড়ে। পুজোর সময়ে এই চারটে দিনে পড়াশোনা না করা ছাড়াও সারা বছরে রয়েছে আনন্দ করার অনেক সুযোগ।
বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন সবসময় কারও না কারও লেগেই রয়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আর মাঠের মধ্যে গিয়ে আনন্দ করে না, তাদের জন্য রয়েছে বড় বড় শপিং মল। সেখানেই ছোট্ট ঘরের মধ্যে রয়েছে শিশুদের খেলার ব্যবস্থা। মা-বাবারা ওভাবেই এখানে তাদের সন্তানরা বেশ একটা ঘরের মধ্যে ভালো থাকবে। মাঠে ঘাটে পড়ে গিয়ে হাত পা কেটে একাকার হবে তার থেকে এই ভালো। পুজোর কটা দিন রেস্টুরেন্টে গিয়ে নামিদামি খাবার-দাবার আর বিজয় দশমীতে নাড়ু করার সময় নেই, তা থেকে কোনো ভালো মিষ্টির দোকান থেকে অনেক টাকা খরচ করে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা।
চাকচিক্যের দৌলতে হারিয়ে যাচ্ছে, সেই পুরনো ভালোবাসার ছোঁয়াগুলো। পুজো ঠিক শুরু হওয়ার আগে, দাদু, ঠাকুরমা, দিদিমার কুচকানো হাতের ছোঁয়ায় ৫০ টাকা গুঁজে দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ ছিল, আজকালকার বাচ্চারা সেই আনন্দ থেকে সত্যিই বঞ্চিত। আগেকার দিনে পুজো শেষ হয়ে গেলে দশমীর দিন মন্ডপটার দিকে তাকিয়ে চোখের জল আসতো, মনে হতো কাল থেকেই আবার সেই আগেকার মতন একঘেয়ে জীবন শুরু। এখনকার বাচ্চারা বা এখনকার মা-বাবারাও সেই কষ্টটা আর পায় না, হয়তো মনে মনে ভাবেন দুর্গাপূজাটা শেষ হলেই ভালো, বাড়িতে থেকে শুধু শুধু বোরিং লাইফ কাটছে। পুরনো দিনগুলো আর ফিরে আসবে না, কিন্তু স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই অসাধারণ দিনগুলোর টুকরো টুকরো ঘটনা। হুপহাপ (Hoophaap) এর পক্ষ থেকে দুর্গাপুজোর একাল-সেকাল নিয়ে এটাই ছিল আমাদের ছোট্ট নিবেদন। নিপাট আনন্দ করুন। চাকচিক্যে বিশ্বাস করবেন না, চাকচিক্য বেশিদিন স্থায়ী থাকে না।