Hoop PlusTollywood

Rituporno Ghosh: ভোজনরসিক ঋতুপর্ণকে জীবনের শেষ দিনগুলিতে খেতে হয়েছিল স্বাদহীন সেদ্ধ খাবার

নয় বছর আগের সেই 30 শে মে-র সকাল আজও ভোলেনি টলিউড। তারকাদের ঘরে বেজে উঠেছিল ফোন, নিউজ চ্যানেলের ব্রেকিং “ঋতুপর্ণ নেই”। এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আর কেউ কোনোদিন স্নেহের সাথে নবাগতদের বুঝিয়ে দেবেন না খুঁটিনাটি। আর কোনোদিন তৈরি হবে না সেই ফিল্ম যা পুঙ্খানুপুঙ্খ বাঙালিয়ানায় পূর্ণ হয়েও সকলের মনোরঞ্জক। আর সেই বিশেষ মোবাইল নাম্বার থেকে মেসেজ আসবে না যাতে লেখা থাকবে, “অনেক আদর”। কেউ রেগে গিয়ে বলবেন না, “বোকার মরণ”। নেই ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituporno Ghosh)। তবে তাঁর না থাকাও যেন আরও বেশি করে থাকা। শেষ দিনগুলি যন্ত্রণার মধ্যেও একটানা কাজ করে গিয়েছেন।

ফিল্ম পরিচালক হলেও শৈশব থেকেই খাদ্যরসিক ছিলেন ঋতুপর্ণ। কিন্তু তাঁর খাওয়া ছিল পরিমিত। একটি পত্রিকায় একবার শৈশবের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর ডিমের ডালনা খাওয়ার শখের কথা। ঋতুপর্ণর শৈশব অর্থাৎ ষাটের দশক। সেই সময় বারোয়ারি দুর্গাপুজো ঘিরে বসত মেলা। তখন ছিল না পিজ্জা, বার্গারের রমরমা। বাঙালি বিদেশ গেলে খেত সেই খাবার। স্যান্ডউইচ মিলত পার্ক স্ট্রিটের নামী রেস্তোরাঁয়। মেলায় ফুচকা, ঘুগনির স্টলের পাশাপাশি বিক্রি হত এগরোল, চিকেন রোল, মাটন রোল। বাড়ির ছেলেমেয়েদের বলা হত ফুচকা খেতে হয় না, ড্রেনের জল মেশানো হয় তেঁতুল জলে। ঘুগনি চলতে পারে অথবা এগরোল। চিকেন অথবা মাটন রোলের গন্ধ মনমাতানো হলেও বাঙালির বিশ্বাস হত না, আদৌ তাতে চিকেন বা মাটন আছে কিনা! বিক্রি হত কুলপি মালাই, বুড়ির মাথার পাকা চুল অধুনা যার নাম ক্যান্ডি। কিন্তু মেলার মাঠে ছোট্ট ঋতুপর্ণর নজর পড়ত এসব ছাড়িয়ে অন্য একটি খাবারের উপর। সেই সময় কাঁচের বাক্সে বিক্রি হত ঈষৎ লালচে রঙের ঝাল ঝাল ডিমের ডালনা।

প্রায় রোজই সেদিকে তাকিয়ে থাকতেন ঋতুপর্ণ। প্রায় রোজ তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের জমানো পয়সা দিয়ে একবার সেই ডিমের ডালনা কিনে খেয়েই ফেলেছিলেন তিনি। অত্যন্ত অতুলনীয় ছিল তার স্বাদ। কিন্তু কিভাবে যেন ঋতুপর্ণর মা পুরো ঘটনাটি জেনে গিয়েছিলেন। ঋতুপর্ণ বাড়ি ঢুকতেই পাকড়াও করেছিলেন তাঁকে। এরপর এক ঘন্টা ধরে বকাবকির পর মা বলেছিলেন, যতগুলি ডিমের ডালনা ঋতুপর্ণ খেতে চান, তিনি বানিয়ে দেবেন। কিন্তু বাইরের ওইসব তথাকথিত অখাদ্য খাওয়া চলবে না। ঋতুপর্ণ মায়ের বকুনি খেয়ে মনে কষ্ট পেলেও ভেবেছিলেন “যাক, ডিমের ডালনা তো খাওয়া হল”! প্রত্যেক পুজোয় মায়ের হাতের শুক্তো ছিল বাঁধা। ঋতুপর্ণ পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, পুজোর সময় তিনি কলকাতার বাড়িতে থাকতেন, শুধুমাত্র মায়ের হাতের শুক্তো খাওয়ার জন্য। শুক্তোর প্রতি ঋতুপর্ণর বিশেষ দূর্বলতা ছিল। সেই কারণেই একবার একটি ফিল্মের সমালোচনা করার সময়, তিনি লিখেছেন, পাতে শুক্তোও দিতে হয়। কিন্তু বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল সব।

জীবনের শেষ দিনগুলি যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছেন ঋতুপর্ণ। তাঁর বাড়ির রান্নার লোক জানিয়েছিলেন, সিদ্ধ খাবার ছাড়া কিছুই খেতে পারছিলেন না তিনি। প্রকৃতপক্ষে, হরমোন থেরাপির জন্য নির্ধারিত ওষুধ ঋতুপর্ণর জীবনে ডেকে এনেছিল বিপদ। বহুদিন ধরেই ডায়াবেটিক ছিলেন তিনি। নিতে হত ইনসুলিন। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ইনসমনিয়া। ফলে ঋতুপর্ণ প্রতিদিন স্লিপিং পিল খেতেন। শারীরিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ডঃ রাজীব শীল (Rajiv Seal)জানিয়েছেন, ঋতুপর্ণ মৃত্যুর আগে গত পাঁচ বছর ধরে ভুগছিলেন প্যানক্রিয়াটাইটিসে। ফলে ওষুধের পাশাপাশি কড়া ডায়েট মানতে হচ্ছিল তাঁকে। মৃত্যুর আগের দিন একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে আনিয়েছিলেন পাতলা স্যুপ। এর বেশি সেদিন কিছুই খেতে পারেননি তিনি।

 

View this post on Instagram

 

A post shared by Sanjib Ghosh (@ghrkbitaa)

পরের দিন সকালে ঋতুপর্ণর বাড়ির কাজের লোক বিশু (Bishu) অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও ঘর থেকে বেরোননি ঋতুপর্ণ। বিশু দরজায় ধাক্কা দিলেও তিনি না খোলায় দ্রুত যীশু সেনগুপ্ত (Jissu U Sengupta)-কে ফোন করেছিলেন বিশু। যীশু ও তাঁর স্ত্রী নীলাঞ্জনা (Nilanjana Sengupta) তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করেন ডঃ নীরূপ মিত্র (Nirup Mitra)-র সাথে। নীরূপ ‘তাসের দেশ’-এ এসে ঋতুপর্ণকে পরীক্ষা করে জানান, ঘুমের মধ্যে ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে প্রয়াত হয়েছেন ঋতুপর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে স্লিপিং পিল নেওয়ার ফলে ব্রেন ও হার্টে চাপ পড়েছিল যার ফল ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলে মতপ্রকাশ করেছেন ডঃ মিত্র।

ঋতুর অবসান হয় না, কিন্তু পরিবর্তন হয়। ঋতুপর্ণ আছেন, তিনি থাকবেন, সেলুলয়েডের মাধ্যমে, বাঙালির চিরকালের প্রিয় শিল্পী হয়ে। কখনও বা নস্টালজিয়া হয়ে অথবা রবি ঠাকুরের গানে “তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি!”

whatsapp logo