সত্যিই কি চলে গেছেন লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)? প্রতি মুহূর্তে সুরের আবহে তিনি কি বেঁচে থাকবেন না? লতা সাক্ষাৎ সরস্বতী। পার্থিব শরীরের বিসর্জন হয়ে যাবে বাগদেবীর বিসর্জনের দিন। কিন্তু থেকে যাবে মোহন গলা। মৃত্যু নয়, জীবন ছিল তাঁর প্রেরণা। মায়ের মৃত্যুর দিনে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন। মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না লতা। ডাক্তারের কড়া নিষেধ সত্ত্বেও কিশোর কুমার (Kishor Kumar)-এর মৃত্যুর সময় ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। মৃত্যুকে সহ্য করতে না পারা লতার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল তিনশো বাই একশো। তাই মৃত্যুর কি সাধ্য তাঁর সামনে দাঁড়ায়? পার্থিব শরীর কি সব?
View this post on Instagram
1929 সালের 28 শে সেপ্টেম্বর মরাঠি মঙ্গেশকর পরিবারে লতার জন্মের সময় আর্থিক দুর্দশা ছিল না। তিনি ছিলেন তাঁর পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর (Dinanath Mangeshkar)-এর আদরের ‘লক্ষ্মী’। নাটকে অভিনয় করতেন, গান করতেন দীননাথ। প্রথমে মেয়ের নাম ‘হেমা’ রাখলেও নিজের রচিত ‘ভাব বন্ধন’ নাটকের ‘লতিকা’ চরিত্রে প্রভাবিত হয়ে দীননাথ মেয়ের নাম রাখলেন লতা। পৃথিবী ছেড়েছিলেন দীননাথ। লতাকে দিয়েছিলেন সঙ্গীতের উত্তরাধিকার। অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা ছেড়ে অবলীলায় সংসারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন লতা। মারাঠি ফিল্মে অভিনয় করতেন প্রথমে। মাত্র নয় বছর বয়সে দীননাথের হাত ধরে মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন লতা। কিন্তু জানতেন না এই হাতটা হঠাৎই ছেড়ে দেবেন দীননাথ। অনেক কষ্ট, অনেক অশ্রু তাঁকে তৈরি করেছিল কিংবদন্তী।
অভিনয় করতে ভালো না লাগলেও পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন ক্যামেরার সামনে। শৈশবে স্কুলে গিয়ে প্রথম দিন বন্ধুদের গান শিখিয়ে শিক্ষকের কাছে বকা খেয়েছিলেন লতা। শিক্ষকের কাছে বকা খেয়ে পরের দিন থেকেই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তের বছর বয়সে সব বদলে গিয়েছিল। মা, আশা (Asha Bhonsle), ঊষা (Usha Mangeshkar), মীনা (Meena Mangeshkar), হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর (Hridaynath Mangeshkar) -এর মুখের দিকে তাকিয়ে তের বছর বয়সী লতা অর্থ রোজগার করতে বেরোলেন। দেখা করলেন ‘নবযুগ চিত্রপট’ ফিল্ম কোম্পানির মালিক বিনায়ক দামোদর কর্ণাটকি (Vinayak Damodar Karnataki)-র সাথে। 1942 সালে মরাঠি ফিল্ম ‘কিতী হাসাল’-এ প্রথম গান রেকর্ড করেন লতা। মঞ্চে গেয়ে লতার প্রথম পারিশ্রমিক ছিল পঁচিশ টাকা। 1945 সালে ‘নবযুগ চিত্রপট’-এর হাত ধরে মুম্বইয়ে এলেন লতা।
View this post on Instagram
লতা হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উস্তাদ আমন আলি খান (Ustad Aman Ali Khan)-এর কাছে। ইতিমধ্যে মৃত্যু হল বিনায়ক দামোদরের। গুলাম হায়দার (Ghulam Haider) নিলেন লতার দায়িত্ব। তিনি লতাকে আলাপ করিয়ে দিলেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় (Shashadhar Mukherjee)-র সাথে। শশধর ফিরিয়ে দিলেন, বললেন ‘বড্ড সরু গলা’। কিন্তু হায়দার হাল ছাড়লেন না। 1948 সালে হায়দারের ‘মজবুর’ ফিল্মে গান রেকর্ড করলেন লতা। ধীরে ধীরে সুযোগ আসতে শুরু করলেও তার সমার্থক ছিল সমালোচনা। বলা হল, তিনি নাকি নীল করেন নূরজাহান (NurJahan)-কে। দিলীপ কুমার (Dilip Kumar) প্রশ্ন তুললেন লতার উর্দু উচ্চারণ নিয়ে। সমালোচনাকে ইতিবাচক ভাবেই নিলেন লতা। উর্দু শিখতে শুরু করলেন তিনি। 1949 সালে ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ হিট করল। পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি লতাকে। একের পর এক রেকর্ড করে গিয়েছেন তিনি। ছিল না কোনো সীমারেখা।
View this post on Instagram
তবে নিজের জন্য খরচ করতে শেখেননি লতা। রেকর্ডিং করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, খিদে পেলে ক্যান্টিন থেকে এক কাপ চা ও কয়েকটি বিস্কুট খেয়ে কেটে যেত তাঁর। কখনও শুধু জল খেয়েই কেটে যেত। পরিবারের জন্য সমর্পিত ছিলেন লতা। 1963 সালে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ’ চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু (Pandit Jawaharlal Nehru)-র চোখ। তখন চলছে ভারত-চিন যুদ্ধ। আজও যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকের আকুতি হয়ে বাজে লতার এই গান। সঙ্গীতের প্রেমে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রাজ কাপুর (Raj kapoor)-এর অভিনয়ের প্রস্তাব।
View this post on Instagram
প্রায় পঁয়ত্রিশটি ভাষায় হাজারখানেক গান রেকর্ড করেছেন লতা। 1975 সালে মুকেশ লস অ্যাঞ্জেলেসের মঞ্চে কয়েক হাজার দর্শকের সামনে লতাকে নিয়ে এসেছিলেন। খালি পায়ে, বেগুনী পাড় -সাদা শাড়ি, হাতে গানের কাগজ নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছিল ‘জীবন্ত সরস্বতী’-র। ততদিনে তিনি নামী গায়িকা। মান্না দে (Manna Dey) বলতেন, লতার কন্ঠে ঈশ্বরের বাস। মান্নাকে বড় দাদা মনে করতেন লতা। ক্রিকেট ভালোবাসতেন লতা। রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরে (Raj Sinha Dungarpure)-র সঙ্গে ছিল বন্ধুত্ব।
গলার জন্য আইসক্রিম না খেলেও আচার খেতেন লতা। প্রতি রবিবার আচার থাকত পাতে। গানের পরিচালনা করেছেন ‘আনন্দ ঘন’ নামে। মরাঠি চলচ্চিত্রের সেই গান পুরস্কার পেয়েছিল। মঞ্চে ‘আনন্দ ঘন’-র নাম ঘোষণার বেশ কিছুক্ষণ পর লতা মঞ্চে উঠলেন পুরস্কার নিতে। সামনে এল রহস্যময় রহস্য। প্রচুর পুরস্কার, প্রচুর সম্মান। তবুও নম্রতা ছিল। ব্রিচ ক্যান্ডিতে ভর্তি হওয়ার আগের দিন করেছেন রেওয়াজ।
View this post on Instagram
দিব্যি সেরে উঠছিলেন। হঠাৎই শারীরিক অবস্থার অবনতি, ভেন্টিলেশন, সব শেষ নাকি নতুন শুরু? অনেক প্রশ্নের উত্তর থাকে অধরা। অনেক লেখাও থাকে অসম্পূর্ণ।
View this post on Instagram