উত্তম কুমার, এক স্বর্ণযুগের স্থপতি, হাসি মুখের আড়ালে তাঁর জীবনের অমসৃণ যাত্রা
1926 সালের 3 রা সেপ্টেম্বর, তৎকালীন উত্তর কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে কিছুক্ষণ আগেই জন্ম হয়েছে একটি শিশুর। মা তখনও আঁতুড়ঘরে। এর মধ্যেই শিশুর দাদু অর্থাৎ মায়ের বাবা শিশুটির নাম ঠিক করে ফেলেছেন, উত্তম। আঁতুড় কেটে বেরিয়ে তাঁর আদুরে মেয়ের অবশ্য সেই নাম পছন্দ হল না। কিন্তু বাবার মুখের উপর কি করে কথা বলবেন তিনি? তাই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর অপছন্দ।
মা একটু আধুনিক নাম রাখতে চেয়েছিলেন। তাই নবজাতকের নামকরণ হল অরুণ। এর মধ্যেই বাড়িতে আগমন হল পারিবারিক গুরুদেবের। তিনি এক যোগীপুরুষ। তাঁর আসার হেতু অবশ্যই নবজাতককে আশীর্বাদ করা। অরুণকে দেখে গুরুদেব বললেন, এই ছেলের একদিন ভারতজোড়া খ্যাতি হবে। আশীর্বাদ করে চলে গেলেন গুরুদেব। আশায় বুক বেঁধে নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন মা।
ধীরে ধীরে অরুণ বড় হচ্ছে। এদিকে ছেলের খুব অভিনয়ের শখ। পড়াশোনায় মোটেও মন নেই। মা রোজ ভাবেন, ছেলের তো জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। সারাদিন শুধুই অভিনয় করার ইচ্ছা। তাহলে কি গুরুদেবের আশীর্বাদ মিথ্যা হয়ে যাবে? এদিকে অভাবের সংসার। একটা পাশ দিয়েই অরুণকে ঢুকতে হল কেরানীর চাকরিতে। তার সঙ্গেই তিনি যোগ দিয়েছেন নাটকের দলে। খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছিল সংসারকে দাঁড় করাতে। অফিস থেকে ফিরেই মায়ের তৈরি পরোটা-আলুপোস্ত খেয়েই তাঁকে ছুটতে হত থিয়েটার করতে। এর মধ্যেই এল সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ, তবে তা খুবই ছোট্ট চরিত্রে। ফিল্মের নাম ‘মায়াডোর’। চরিত্রটি হল বরের। বর বিয়ে করতে এসে মার খেয়ে পালাবে, এইটুকুই ছিল অরুণের পার্ট। সেই পার্টেই মন দিয়ে অভিনয় করলেন অরুণ। বাড়ির সকলের মনে আনন্দ। এবার তাঁদের অরুণকে দেখা যাবে সিনেমায়। কিন্তু বিধি বাম। মুক্তি পেল না ‘মায়াডোর’। দেখা হল না অরুণের প্রথম অভিনয়।
View this post on Instagram
আবারও উদয়াস্ত পরিশ্রম। একদিকে সংসারের অভাব, অপরদিকে থিয়েটার, মাঝে স্টুডিওপাড়ায় একটু পার্টের জন্য জুতোর শুকতলা খুইয়ে ফেলা। রাতে শুয়ে অরুণের মনে হতো, এইভাবেই কি তিনি ফুরিয়ে যাবেন? কিন্তু অরুণ হাল ছাড়লেন না। 1948 সালে ‘দৃষ্টিদান’ ফিল্মে সুযোগ পেলেন অরুণ। শুরু হল উত্তম হয়ে ওঠার সাধনা। একের পর এক ফিল্ম, একের পর এক চরিত্র। সব চরিত্রেই তিনি সেরা। 1966 সালে সত্যজিৎ রায় (satyajit Ray)-এর ‘নায়ক’-এ উত্তম যেন তুলে দিয়েছিলেন নিজের জীবন। মুম্বই থেকেও একের পর এক অফার আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু ততদিনে উত্তমের চারপাশে জুটে গেছে অনেক স্তাবক। তারা বোঝালো উত্তমকে, কলকাতা না ছাড়তে। অবশ্যই উত্তমের কেরিয়ারের জন্য নয়, তাদের অফুরন্ত মদের যোগানের জন্য। ফলে রাজ কাপুর (Raj kapoor)-এর একের পর এক কালজয়ী ফিল্মের অফার ফিরিয়ে দিলেন উত্তম।
View this post on Instagram
টালমাটাল হয়ে উঠেছিল উত্তমের দাম্পত্য জীবনও। উত্তমের সুখ-দুঃখের সাথী, তাঁর সহধর্মিণী গৌরী দেবী (Gauri devi) স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন উত্তমের সঙ্গে সুপ্রিয়া (supriya devi)-র সম্পর্কের কথা শুনে। একসময় উত্তম সুপ্রিয়াকে বিয়ে করার অনুমতি চেয়েছিলেন গৌরীর কাছে। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন গৌরী। জানতেন, উত্তমকে আটকাতে পারবেন না। উত্তম-সুপ্রিয়া মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করলেন। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে রয়ে গেলেন গৌরী। উত্তম ও সুপ্রিয়া নতুন সংসার পাতলেন।
View this post on Instagram
কিন্তু এই সময় থেকেই ধস নামতে শুরু করল উত্তমের জীবনে। দুটি সংসার চালাতে তাঁকে মাসে অন্তত চল্লিশ হাজার টাকা রোজগার করতে হত। উত্তম নিজেই এই কথা জানিয়েছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় (shubhendu chatterjee)-কে। আর্থিক দুশ্চিন্তার ফলে অসময়েই শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করল অসুখ। তার উপর মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ উত্তমকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছিল।
সুপ্রিয়ার সঙ্গেও মতানৈক্য শুরু হয়েছিল। একসময় সুপ্রিয়াকে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন উত্তম। তখন শরীর রীতিমতো ভেঙে পড়েছে। সেই অবস্থাতেই শুরু করলেন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র শুটিং। সিঁড়ি থেকে নামার একটি দৃশ্য ছিল। বারবার নেমে আসছেন, কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। পরিচালক উত্তমকে বলছিলেন, শট পারফেক্ট আছে। কিন্তু তিনি যে উত্তম কুমার। বাঙালির অতি প্রিয় মহানায়ক। তিনি বারবার রিটেক দিচ্ছিলেন। হঠাৎই শরীরটা খারাপ করে উঠল। চোখের সামনে ছেয়ে এল অন্ধকার। স্টুডিওর রাশিকৃত আলো, সবকিছু কেমন আবছা হয়ে যাচ্ছে কেন? ছুটে আসছেন পরিচালক, সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সুমিত্রা (sumitra chatterjee) ছুটে এসেছেন। তাঁর ‘দাদা’ ডাক উত্তমের কানে পৌঁছাচ্ছে কি? অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল যে, অনেক কমিটমেন্ট, উঠে দাঁড়াতে হবে! পারলেন না উত্তম। অচেতন অবস্থায় বেলভিউ নিয়ে যাওয়া হল। ষোলো ঘন্টা যমে-মানুষে লড়াইয়ের শেষে জিতে গেল অমোঘ মৃত্যু। হার মানছে চিকিৎসকরা। মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে মহানায়কের মৃত্যুসংবাদ ঝড়ের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
গৌরীদেবী নিজেও তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। আগেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, এবারেও হাহাকার করলেন না। শুধু সুপ্রিয়া যেতে পারলেন না উত্তমের কাছে। তাঁকে যেতে দেওয়া হল না। মালা দিয়ে সাজানো ভালোবাসার মানুষ অরুণের মাথার কাছে বসেছিলেন গৌরী। সেদিন যাবার বেলায় ভেঙে পড়েছিল মহানগরী। কোথাও অলক্ষ্যে যোগীপুরুষ গুরুদেবের কথা মিলে গিয়েছিল। এসেছিলেন গন্ধর্বলোক থেকে বাংলা ফিল্মের ইতিহাস রচনা করে মহানায়ক হতে, কাজের শেষে আবারও সেখানেই ফিরে গেলেন।
উত্তমের মৃত্যুর পর তাঁর বডি ডাবল শেষ করেছিলেন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র কাজ। উত্তমের যেসব ফিল্মে অভিনয় করার কথা ছিল, সেগুলোতে অন্য নায়করা অভিনয় করেছিলেন। ডাবিং আর্টিস্ট দিয়ে উত্তমের ভয়েস ডাবিং করানো হয়েছিল কয়েকটি ফিল্মে।
অরুণের অর্থ সূর্য। উত্তমের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই অস্তমিত হয়েছিল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সূর্য। নেমে এসেছিল কর্মহীনতা ও দারিদ্র্যের অভিশাপ। চলে গেলেন মহানায়ক। তাঁর উত্তরাধিকার সামলাতে, বাংলা সিনেমাকে আবারও স্বকীয়তা ফিরিয়ে দিতে স্টুডিওর ফ্লোরে এলেন এক নতুন নায়ক, প্রসেনজিৎ। শুরু হল বহমানতা। কিন্তু মহানায়ককে অতিক্রম কেউ করেননি, করতে চাননি। তিনি আজও বাঙালির হৃদয়ে চির বিরাজমান। শরীরের মৃত্যু হয়, কিন্তু শিল্পীর মৃত্যু হয় না।
View this post on Instagram