Hoop Special

নাম পরিবর্তন করে হয়েছিলেন তারকা, ঝলমলে স্টারডমের আড়ালে সুপ্ত ছিল যাঁদের প্রকৃত পরিচয়

নাম পরিবর্তন করে রূপোলি পর্দায় আসা নতুন নয়। বহু আগে যখন সমাজ থিয়েটারের বিরোধিতা করত তখন থেকেই নাম পরিবর্তন করে বিনোদনজগতে আসার ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে বায়োস্কোপ ও তারও পরে সিলভার স্ক্রিনে এই ধারা এখনও বজায় রয়েছে। ছেলেরা সাধারণতঃ নিজেদের নামের পরে বা আগে কুমার ব্যবহার করতেন এবং মেয়েরা নামের পরে ব্যবহার করতেন দেবী। প্রথমেই আসা যাক বাঙালির একান্ত আপন মহানায়ক উত্তমকুমার (uttam kumar)- এর কথায়।

উত্তমকুমারের জন্মের পর তাঁর দাদু অর্থাৎ উত্তমের মায়ের বাবা নবজাতকের নাম দিয়েছিলেন উত্তম। কিন্তু উত্তমের মায়ের পছন্দ হয়নি এই নাম। তিনি তাঁর ছেলের এই নাম নাকচ করে নিজে নাম দিয়েছিলেন অরুণ। সেই সময় একদিন নবজাতক অরুণকে দেখতে এলেন অরুণের মায়ের গুরুদেব। নবজাতককে দেখে তিনি বলেছিলেন, এই ছেলে একদিন অনেক নাম করবে। কিন্তু অরুণ বড় হওয়ার পরে থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন এবং তার পাশাপাশি একটি ছোটখাট চাকরি করতেন। দাদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তরুণ কুমার (Tarun kumar) বলেছেন, দাদা অফিস থেকে এসেই মায়ের তৈরী করে রাখা পরোটা-আলুপোস্ত খেয়ে ছুটতেন থিয়েটার করতে। কিন্তু মায়ের নিজের ছেলে অরুণের প্রতি আর কোনো আশা ছিল না। ‘মায়াডোর’ নামে একটি ফিল্মে জুনিয়র আর্টিস্টের কাজ করলেও সেই ফিল্মটিও মুক্তি পায়নি। অরুণ একইসঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির রাজনীতি, ব্যর্থতা ও ডিপ্রেশনের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। কিন্তু অরুণকে নিজেকে পরিবর্তন করতে হল ‘উত্তম’-এ। সত্যি হলো গুরুদেবের ভবিষ্যদ্বাণী। অরুণ বাঙালির হৃদয়ে অক্ষুণ্ণ আসন স্থাপন করলেন উত্তমকুমার নামে।

পাবনার শ‍্যামবর্ণা রমার মনে অভিনয়ের শখ থাকলেও সমাজের নিয়মেই তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কলকাতার বনেদী সেন বাড়িতে। কিন্তু ভাগ্যই যেন রমাকে নিয়ে এসেছিল পাবনা থেকে কলকাতায়। রমার স্বামী দিবাকর সেন (Dibakar sen) এবং শ্বশুর কিন্তু রমাকে সমর্থন করতেন। কাজের খোঁজে স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই রমা যেতেন টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায়। তখন কানন দেবী (kanan debi)-দের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে বাংলা সিনেমায়। বহু কটুক্তি, বহু বাধা, অনেক লড়াই করে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে নিজের নাম তৈরী করেছিলেন রমা। কিন্তু রমা নামে নয়, আপামর বাঙালির চিরকালীন মহানায়িকা, আভিজাত‍্যের প্রতীক সুচিত্রা সেন (suchitra sen) নামে।

মায়ের পথেই হেঁটেছিলেন মেয়েও। সুচিত্রার একমাত্র মেয়ে শ্রীমতী(srimati)-র বিয়ে হয়েছিল রাজপরিবারে। জয়পুরের মহারানী গায়ত্রী দেবী (Gayatri devi) ছিলেন শ্রীমতীর দূর দূরসম্পর্কের শাশুড়ি। ফলে সিনেমায় আসতে হলে শ্রীমতীর হয়তো নিজের নাম ব্যবহার করতে সমস্যা ছিল। নিজের নাম ব্যবহার করলেন শ্রীমতী, তবে ডাকনাম। শ্রীমতী দেববর্মা-কে দর্শক চিনল মুনমুন সেন (munmun sen) নামে।

বাঈজীর মেয়ে ফতিমা রশিদ (Fatima Rashid)-এর মা জদ্দনবাঈ (Jaddanbai)-কে আজ বলিউড বলে কিংবদন্তী। কিন্তু তৎকালীন যুগে এই সমাজই তাঁকে পরিত্যক্ত করেছিল। হাল ছাড়েননি জদ্দনবাঈ। নিজের মেয়ে ফতিমার জন্য লড়াই করে অভিনয়জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁকে। বিখ্যাত অভিনেত্রী হয়েছিলেন ফতিমা, ‘নার্গিস’ নামে।

মাধবীর দিদি ও জামাইবাবু থিয়েটার করতেন। মারাঠি চিৎপবন ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে মাধবীর ফিল্মে আসার সময় কেউ জানতেন না, এই ‘মোহিনী’ একদিন হয়ে উঠবেন আইকন, শুধু পাল্টে যাবে নাম, মাধবী পরিণত হবেন মাধুরী দীক্ষিত (Madhuri Dixit)-এ।

মায়ের পার্সে কালো এলাচের গন্ধ পাওয়া ভানুরেখা তার ভাইবোনদের দেখভাল করত। কিন্তু চোখে ছিল অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন। ভবিষ্যতে ভানুরেখা শুধু অভিনেত্রীই হল না, পরিচিত হল বলিউডের রহস্যময়ী সুন্দরী নামে। মেরুন লিপস্টিক হয়ে গেল তার ‘সিগনেচার’। রেখা (Reekha)-র উমরাও জান আদায় মজলেন সিনেপ্রেমীরা।

কলকাতায় নকশাল আন্দোলনের সময় নকশাল করা ছাত্র গৌরাঙ্গ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গা ঢাকা দিয়েছিল মায়ানগরী মুম্বইতে। কিন্তু তখনও সে জানত না, ভারত তাকে চিনবে এক শক্তিশালী অভিনেতা ও নৃত্যশিল্পী মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun chakraborty) নামে।

কলকাতার রকে আড্ডা দেওয়া কেদারনাথ ভট্টাচার্যের গান পাড়ার সকলের পছন্দ হলেও কেদারনাথের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। সেই স্বপ্নের খোঁজেই কেদারনাথ পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বই। তাঁর গানে মাত হয়ে গিয়েছিল আসমুদ্র হিমাচল। কেদারনাথ হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত গায়ক কুমার শানু (kumar shanu)।

কিন্তু বায়োস্কোপের আগে ছিল থিয়েটার। সেই সময় থিয়েটারে নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন বারাঙ্গনারা। এমনই একজন বারাঙ্গনা স্থাপন করেছিলেন এশিয়ার প্রথম অভিনয় শেখার স্কুল। তাঁর স্থাপনা, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর জীবন আজ সবকিছুই চলে গেছে বিস্মৃতির গর্ভে। কারও তাগিদ ছিল না তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার। সেই বারাঙ্গনা থিয়েটারে গোলাপসুন্দরী নামে পরিচিত হলেও সমাজে বাঁচার তাগিদে তিনি নাম পরিবর্তন করে হয়েছিলেন সুকুমারী দত্ত (sukumari dutta)। হয়তো তিনিই ছিলেন প্রথম নারী যিনি আগামী প্রজন্মকে অভিনয় শেখানোর তাগিদে বদলে ফেলেছিলেন নিজের পরিচয়।

Related Articles