দেখতে দেখতে আটাত্তরের কোঠায় পৌঁছে গেলেন বেগম আয়েশা সুলতানা (Aisha Sultana)। এই নাম শুনে অনেকেই হয়তো হকচকিয়ে যাবেন। কিন্তু বিয়ের সময় শর্মিলা ঠাকুর (Sharmila Tagore)-কে গ্রহণ করতে হয়েছিল এই নাম। বঙ্গতনয়ার সংজ্ঞা বলিউডের মাটিতে পাল্টে দিয়েছিলেন শর্মিলা। পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির মেয়ে শর্মিলা মাত্র তের বছর বয়সে অভিনয়ে আসেন। সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) ‘অপুর সংসার’-এ অপর্ণার চরিত্রের জন্য খুঁজছিলেন এক নিষ্পাপ অথচ অভিজাত মুখ। শর্মিলাই হলেন তাঁর উত্তর। অপর্ণার চরিত্রে তাঁকে দেখে আটপৌরে বাঙালি মেয়ে ছাড়া কিছুই মনে হওয়ার উপায় নেই। একরকম পরিবারের অমতেই বম্বে পাড়ি দিয়েছিলেন শর্মিলা। হয়তো মনে মনে ঠিক করেছিলেন, তৈরি করবেন ইতিহাস। পাশে ছিলেন বোন ঐন্দ্রিলা ঠাকুর (Aindrila Thakur)। ‘কাবুলিওয়ালা’-র সেই ছোট্ট মিনিই ঐন্দ্রিলা যিনি তুখোড় শিশুশিল্পী হয়েও বড় হয়ে লাইমলাইট থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন।
View this post on Instagram
বম্বেতে সেই সময় নায়িকাদের সাথে থাকতেন তাঁদের মায়েরা। পার্টিতে নায়িকারা যেতেন সাদা শাড়ি পরে। হাতে থাকত কোকাকোলার গ্লাস। ঠাকুরবাড়ির মেয়ের পছন্দ হল না বম্বের নায়িকাদের ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া। শর্মিলা বুঝেছিলেন, ইন্ডাস্ট্রির হাওয়া বদলাতে হবে। কিন্তু তাহলে চাই কাজ। সামান্য অপেক্ষার পর এসে গেল সুযোগ। ‘আরাধনা’-র প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন অপর্ণা সেন (Aparna Sen)। কিন্তু রাজি হয়ে গেলেন শর্মিলা। জানতেন, মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। চিত্রনাট্যের নিয়ম মেনেই আসবে বলিরেখার দিন। তবু চরিত্রটির গুরুত্ব বুঝেছিলেন তিনি। ‘অপুর সংসার’-এর মাটির তাল থেকে শুরু হল প্রতিমা গড়ার পালা। তা সম্পূর্ণ করল ‘আরাধনা’। তৎকালীন সময় ‘আরাধনা’-কে একরকম ছক ভেঙে তৈরি করা ফিল্ম বলা যায়। ‘আরাধনা’ প্রমাণ করেছিল প্রকৃত ভালোবাসা বেঁচে থাকে শেষ নিঃশ্বাস অবধি। কুমারী মাতৃত্ব তার প্রতিফলন।
View this post on Instagram
কিন্তু এরপরেও বাকি ছিল অনেক কিছুই। সম্পর্ক তৈরি হল পতৌদির শেষ নবাব মনসুর আলি খান পতৌদি (Mansoor Ali Khan Pataudi)-র সাথে। ক্রিকেট জগতে তখন তিনি পরিচিত টাইগার পতৌদি নামে। পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির মেয়ের বিয়ে হল মুসলমান নবাব পরিবারে। তবে শর্মিলার উপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের চাপ ছিল না। কিন্তু অযথা বিতর্কের সৃষ্টি করেন এক হিন্দু ধর্মগুরু। তিনি শর্মিলাকে মুসলমান পরিবারে বিয়ে করার অপরাধে ধর্মচ্যুত করেছিলেন। শর্মিলার কিছু দূরের আত্মীয়রাও এই ঘটনায় সামিল ছিলেন। সকলকে একপ্রকার জবাব দিতেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম পরিবর্তন করে শর্মিলা হন আয়েশা। কিন্তু তাঁর স্ক্রিন নেম একই থেকে যায়।
View this post on Instagram
তবে ততদিনে টাইগারের সাথে শর্মিলার সম্পর্ক হয়ে উঠেছে বন্ধুত্বের। প্রেম বন্ধুত্বের রূপ নিয়েছিল বিয়ের আগেই। 1966 সালে ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনের কভার পেজের জন্য বিকিনি পরে ফটোশুট করেছিলেন শর্মিলা। বলিউড ও অভিনেত্রীর চারপাশের সমাজ তাঁকে ধিক্কার জানিয়েছিল। কিন্তু সমর্থন করেছিলেন টাইগার। এরপর 1967 সালে শর্মিলা আবারও বিকিনি পরেন ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ ফিল্মে। সেই সময় বলিউড প্রতিবাদ করতে পারেনি। কারণ সকলে বুঝতে পেরেছিলেন, স্টিরিওটাইপ ভেঙে শুরু হল নায়িকাদের পরিবর্তনের পালা যার প্রারম্ভ শর্মিলাকে দিয়ে।
View this post on Instagram
1968 সালে বিয়ে হল টাইগার ও শর্মিলার। আজীবন টাইগার সমর্থন করেছেন স্ত্রীকে। বিয়ের পর নবাব পরিবারে খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অসুবিধা হত বঙ্গতনয়ার। শর্মিলা ভাত খেতে পছন্দ করতেন। কিন্তু নবাব পরিবারের সদস্যরা তা খেতেন না। টাইগার অচিরেই বুঝতে পারেন শর্মিলার খাওয়ার অসুবিধার কথা। তাঁর নির্দেশেই তৈরি হত শর্মিলার পছন্দের মেনু।
View this post on Instagram
আজ টাইগার নেই। তবু শর্মিলা অধিকাংশ সময় কাটান পতৌদি প্যালেসে। কারণ তার প্রতিটি ইটে রয়েছে টাইগারের স্মৃতি। পতৌদি প্যালেসের বাগানে মাটির নিচে চিরঘুমে শুয়ে রয়েছেন তিনি। সময় পেলেই টাইগারের সমাধিতে যান শর্মিলা।
View this post on Instagram
আটাত্তর বছর বয়সের জন্মদিনেও তাঁর স্মৃতি জুড়ে শুধুই টাইগার, রক্ষণশীল মনোভাবের বিরোধী সেই পুরুষ যিনি অবলীলায় হয়ে উঠেছিলেন শর্মিলার মেরুদন্ড। ‘হুপহাপ’ (HOOPHAAP)-এর তরফে শর্মিলা ঠাকুর ওরফে বেগম আয়েশা সুলতানার জন্মদিনে রইল অনেক শুভেচ্ছা। একটা কথা তো লেখাই হয়নি। এত বছর বলিউডে কাটানোর পরও কিন্তু শর্মিলা বাংলা বলতে ভুলে যাননি এবং বাংলা ভাষা পড়ার ক্ষেত্রেও সিদ্ধহস্ত।
View this post on Instagram