Hoop Special

আজকের গল্প: কলেজ প্রেম

গার্গীকে আজ সকালে ফেসবুকের এক অচেনা বন্ধু জিজ্ঞাসা করলো, “সিনেমা হলে শেষ সিনেমা কী দেখেছো?” গার্গী মেসেজটি পড়ে আর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। চোখ দিয়ে শুধু জল বেরিয়ে এলো। গার্গীর মেয়ে টিনা মায়ের জন্য মাস ছয়েক আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল যাতে সংসারের কাজ সেরে বাড়তি সময়টুকু মা নিজের মতো করে কাটাতে পারে। প্রথমে গার্গীর এসব নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিলনা। পরে স্মার্টফোন ইউজ করাটা পান খাওয়ার মতোই, ফেসবুক ওয়াটসঅ্যাপ এখন গার্গীর নখদর্পনে। গার্গী ইউটিউবে পুরোনো দিনের সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। টিভিতে সিরিয়াল নয়,হটস্টারে শ্রীময়ী, জি ফাইভে রানি রাসমনি দেখতে ভালোবাসেন।

এই করতে করতে গার্গীর কলেজের বন্ধু বান্ধবের সাথে আবার নতুন করে কথা বলা শুরু হয়। রিয়া, সোনালী, অনুজা, অন্বেষা আরো অনেক বন্ধুদের সাথে। গার্গী যখন ছোট ছিল, তখন ইচ্ছে ছিল বন্ধুদের সাথে গার্লস হ্যাং আউটে যাবে, সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে চাঁদের অপরূপ রূপ দেখবে। দেখবে অনেক ঝিঁঝিঁ পোকা। বাড়ির শাসনে সেই সব ইচ্ছে অনেক দূরে পালিয়েছে। পড়ুয়া গার্গীও কলেজে পড়তে পড়তে পড়তে ভাবেনি আজ নিজের জীবন হঠাৎই এভাবে থমকে যাবে একদিন। এক সময়ের স্কুল টপার এবং কলেজে ইংলিশ অর্নাসে যে মেয়ে টপার সে হয়তো অনেক কিছু নিজেই অ্যাচিভ করতে পারতো জীবনে….কিন্তু আজ সেই সব ভাবা শুধুই বিলাসিতা।

হঠাৎ একদিন বাবা এসে বললেন, পড়াশোনা থামিয়ে পরের বাড়িতে মন দিয়ে সংসার করতে হবে। মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে তাই বাবাকে বড্ড ভয় পেতেন। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলায় বেনারসী শাড়ি, সোনার গহনা পড়ে মাঘ মাসের এক শুভ লগ্নে একজন অচেনা লোকের সামনে পান পাতা সরিয়ে নিমেষে গার্গীর জীবন পুরো পাল্টে যাবে তা ভাবতেই পারেনি কোনোদিন।

এরপর গার্গীর জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন। যখন সে অনিমেষের সাথে সাত পাকে ঘুরছিল তখন সমুদ্রের পাড়ে বসে চাঁদের আলো দেখার স্বপ্নকে বিয়ের আগুনে ভস্মীভূত করে দিল। ধীরে ধীরে পাহাড়ি এক বাংলোয় গার্গী সংসার করতে করতে নিজেকে হারিয়ে ফেললো। একদিন পাহাড়ের সন্ধ্যায় হঠাৎ গার্গীর গ্র‍্যাজুয়েশনের রেজাল্ট আউটের দিনের কথা মনে পড়লো। সেই পুরনো দিনের কিছু মুহূর্ত। কলেজে প্রথম ফার্স্ট ক্লাস সাথে টপার, হাসিমুখে বাড়ি ফিরছিল ভাবছিল বাবা খুব খুশি হবে। এবার নিজের স্বপ্নের কথা বলবে। বাড়ি ফিরে এসে চেঁচিয়ে মাকে ডাকলো,”মা জানো….”। গার্গীর মা হাত ধরে ঘরে নিয়ে এসে বললেন, “একটা ভালো লাল রঙের শাড়ি আর চুল বেঁধে সুন্দর করে রেডি হয়ে নাও সোনাই, তোমার বাবার এক বন্ধুর পরিচিত আসবেন তার ছেলের সাথে তোমায় দেখতে। ভালো চাকরি করে..উচ্চ বংশ..বিয়ের পর বাইরে থাকার সুযোগ পাবে। তোমার বিয়ে ঠিক করেছি আমি আর বাবা। মাকে আর গার্গী নিজের কলেজ টপার হওয়ার কথা বলা হয়নি। সুন্দর করে শাড়ি পড়ে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে হাজির হয় বিয়ের ইন্টারভিউ দিতে। উল্টোদিক থেকে প্রশ্ন আসে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি? গার্গী বললো হ্যাঁ। এরপর বলা হয় মা একটু হেঁটে দেখাও তো, একটু চুলটা খুলে দেখাও, একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাও তো। এরপর বিয়ের কথা পাকা হয়ে যায়। আর কেউ জানলো না গার্গীর সেই সর্বোচ্চ নাম্বারের বিষয়টুকু।

সেই বছর দোল পূর্ণিমায় ফুলের আবির মেখেছিল গার্গী। গার্গীর বিয়ের আগে শেষ দোলযাত্রা। বাড়ির ছাদে আয়োজন করা হয় ছোট অনুষ্ঠান। সোনালী, অনুষ্কা, অন্বেষা, জয়ন্ত, অর্পণ, অরূপ আরো তিন চার জন এসেছিল। সেদিন সকলে মিলে সারা দুপুর ধরে আবির রঙ খেলেছিল। বাতাসে রঙের খেলা। অর্পণ গার্গীর গালে লাল আবির মোটা করে মাখিয়ে দিয়েছে। অত জল দিয়ে ধুয়েও সেই রঙ মোছেনি। অর্পণের দিকে তাকিয়ে গার্গী বেশ লজ্জা পেয়েছিল। সেইদিন অর্পণ গার্গীর হাতে একটি চিঠি দিয়েছিল। তাতে স্পষ্টভাবে লেখা, “ভালো চাকরির চেষ্টা করছি। ততদিন অপেক্ষা করিস।” কিন্তু এরপর গার্গীর অপেক্ষা করা আর হয়নি। বাড়িতে যে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

দেখতে দেখতে ২৪ বছর কেটে গিয়েছে। আজ সে একজন স্বাধীনচেতা বিধবা মা। অনিমেষ গত পাঁচ বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছে। সংসার করতে করতে অনিমেষকে সে একপ্রকার ভালোবেসে ফেলেছিল। তারপর তো অনিমেষ আর গার্গীর এক কন্যা সন্তান এলো টিনা। মেয়ে টিনাই মায়ের বন্ধুদের নিয়ে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে দিয়েছে। সেই পুরনো কলেজের বন্ধুরা ঠিক করলো এবছর শান্তিনিকেতনে রিইউনিয়ন হবে। ১০ই মার্চ শান্তিনিকেতন দোল উৎসবে আবার ২৪ বছর পর একসাথে দোলে খেলা হবে। গার্গী জানে সে যাবেনা তাই নেট অফ করে বাড়ির কাজে মন দিল।

হঠাৎ নেট অন করতে ম্যাসেঞ্জারে ফের টুং করে আরো একবার মেসেজ আসে, “কি হল? বলা যাবে না বুঝি..!” আজ রবিবার, টিনার কলেজ ছুটি। টিনা শুনতে পায় মায়ের ফোনে ম্যাসেজ আসার আওয়াজ। টিনা বলে উঠলো, “মা তোমার ফোনে ম্যাসেজ ঢুকলো। দেখো কে কি বলছে। তক্ষুনি গার্গী বলে উঠলো, “ছাড় তো আসুক।” তখন টিনা বললো, “মা তোমাকে কি কেউ বিরক্ত করছে? তাহলে বলো আমি ব্লক করে দিচ্ছি।” গার্গী বললো, “না রে তেমন কিছু না, কাজের চাপে কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কোন রিপ্লাই না দিয়ে এখানেই শেষ হয় সেই চ্যাটের কথোপকথন, আর ফোনে কথা বলা হয়নি।

এরপর গার্গীর ফোনে কলেজের বন্ধু সোনালী ফোন করে বলল, “কি রে কেমন আছিস? গ্রুপে যে জিজ্ঞেস করলাম, ১০ই মার্চ সবাই মিলে শান্তিনিকেতন যাওয়া হবে। কিছু বললি না তো..” তখন ফোনের ওপার থেকে গার্গী জানালো, “হ্যাঁ রে আমি ভালো আছি..তুই কেমন আছিস? না রে,, আমার যাওয়া হবেনা। অনি (অনিমেষ) মারা যাওয়ার পর সাদা রঙই আমার কাছে আপন। এই বয়সে আর রঙ খেলতে যাই কি করে! আর আমি চলে গেলে এখানে মেয়েকে কে দেখবে?” সোনালী বললো, “তোর মেয়ে টিনাই চায় তুই আমাদের সাথে শান্তিনিকেতন যাবি। কোনো কথা নয়, চুপচাপ যাবি আমাদের সাথে। হঠাৎ করে টিনা এসে বলে উঠলো, “আর কোনো কথা নয় মা, তুমি ভালো করে মাসিমনিদের সাথে শান্তিনিকেতন ঘুরে আসো। আমি নিজের খেয়াল রাখতে জানি।” যদিও মনে মনে টিনা নিজেও শান্তিনিকেতন যাওয়ার প্ল্যান করে ফেলেছে একটা বিশেষ কারণে।

অবশেষে সবাই মিলে চলে এলো শান্তিনিকেতন। ওখানে গিয়ে পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পেরে বেশ খুশি গার্গী। হঠাৎই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, “কি ম্যাডাম আমি কিন্তু উত্তরটা পেলাম না। সিনেমাহলে শেষ কি সিনেমা দেখেছো? এখনো সিন করার সময় হয়নি বুঝি নাকি আমার কথা পুরো পুরি ভুলেই গেছো?” পিছনের দিকে তাকিয়ে গার্গী অবাক, “আরে অর্পণ তুমি? তুমি কোথা থেকে। আরে না না আসলে আমি অনেক দিন ধরে ম্যাসেঞ্জারের নোটিফিকেশন অফ করে রেখেছি। তাই বুঝতে পারিনি। না আমি শেষ তোমার সাথে হলে গিয়ে ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’ সিনেমা দেখেছিলাম। বিয়ের পর অনিমেষের সাথে আর দেখা হয়নি। এসব ছাড়ো অর্পণ তুমি বলো কেমন আছো? বৌদি কেমন আছেন? আগের থেকে তুমি অনেকটাই চেঞ্জ হয়ে গিয়েছো। তাই ফেসবুকে বুঝতে পারিনি।” অর্পণ বললো, “ভালো আছি। আমি বিয়ে করিনি কোনোদিন। পরিবর্তন তো আসবেই। পরিবর্তন তোমারো এসেছে। আগে কি সুন্দর তুমি রঙিন শাড়ি পড়তে আজ শুধুই সাদা কেন এই সাজ?” তখন বলে উঠলো গার্গী, “বিধবাদের রঙিন পড়তে নেই।”

– স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীকে সাদা পড়তে হয়? তখনই অর্পণ বলে উঠলো। তুই কোন যুগে বসবাস করিস একটু বলবি। আজকের দিনে এসব কে মানে। গার্গী বলে উঠলো, “আমি মানি। অর্পণ বলে, “ছাড় হোটেলে চল। গিয়ে রেস্ট নি সবাই। পড়ে কথা হবে।”

এরপর পরদিন দেখা সকলের। ছাতিমতলায় হাজির সকলে। থালায় করে সাজানো লাল, গোলাপী, সবুজ, হলুদ, কমলা আবির। সব বন্ধুরা সযত্নে দোল খেলতে ব্যস্ত। অন্বেষা গার্গীকে আবির দিতে এলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, “তোরা দোল খেল, আমি একপাশ দিয়ে দেখছি। আমার জীবনে কোনো রঙ মানায়না, বেরঙিনই ভালো। তখনই অর্পণ এসে পিছন থেকে গার্গীর গালে লাল আবির মাখিয়ে দিল। সাথে সাথে গার্গীর ২৪ বছর আগের পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। তখনই গার্গী বলে উঠলো, “অর্পণ এটা তুমি কি করলে? তুমি জানোনা বিধবাদের জন্য লাল রঙ পাপ। সেইসময় হঠাৎ টিনা এসে বলে, “কিসের জন্য পাপ মা? তুমি বিধবা বলে কি তোমার বুঝি কোনো স্বপ্ন নেই? তুমি এই মানুষটাকে ভালোবাসো তাও এত ভয় কিসের। গার্গী বলে উঠলো, “তুই কি করে জানলি?” টিনা বললো, “আমি সব জানি। তোমার সযত্নে রাখা চিঠিটি আমি দেখেছি। যেখানে কাকু লিখেছিল, “আমার চাকরি পাওয়া অব্দি অপেক্ষা করিস..” তখন উপায় ছিল না কিন্তু আজ উপায় আছে। আজ আর দাদু দিদা নেই। তুমি তোমার মতো বাঁচো। অর্পণ বলে ওঠে, “আমি আজও তোর জায়গা কাউকে দিতে পারিনি আর ভবিষ্যতেও পারবোনা। আজও তোকে বড্ড ভালোবাসি। তুই ভালোবাসিসনা? তখনই গার্গী কাঁদতে কাঁদতে বললো, “খুব… ভালোবাসি।” মেয়ে টিনা আনন্দে উৎসাহী হয়ে বললো, “তাহলে আর কিসের অপেক্ষা, তুমিও অর্পণ কাকুকে আবির মাখিয়ে দাও। এরপর গার্গী আবির দিল অর্পণের গালে। এরপর এক মিষ্টি আলিঙ্গন। টিনা এই দৃশ্যে বড্ড খুশি, সাথে গার্গীর ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা। পুরোনো কলেজর প্রেমের পুনর্মিলন ঘটলো এভাবেই।

আধুনিক মানসিকতায় আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিধবা বিবাহের এক সুন্দর পরিণতি।
গল্প: অর্পিতা বসু
পোস্টার ডিজাইন: কৌশিক ব্যানার্জি

গল্প কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে অবশ্যই লাইক কমেন্ট এবং শেয়ার করবেন। এরকমই আরো নতুন নতুন গল্প ও অজানা তথ্য পেতে সঙ্গে থাকুন।

Related Articles