বাড়ি বসেই সিকিম ভ্রমন, বাবা হরভজন সিং মন্দিরের অলৌকিক কীর্তিকলাপ ঘুরে দেখুন
কিছু সৈনিকের মৃত্যু হয় না, এখনও একজন সৈনিক অদৃশ্য হয়েও কর্মরত। এখনও তার নামে বেতন জমা পড়ে, বছরে দুবার ছুটিও পায় সে। জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনের টিকিট কেটে, এক সেনাকে সঙ্গে দিয়ে তাঁর ছবি পাঠানো হয় বাড়িতে ৷
কাহিনী মনে হলেও এটাই বাস্তব। যারা ভ্রমন পিপাসু বা যারা সিকিম গেছেন এবং এই সৈনিকের মন্দির দেখেননি তারা হয়তো দারুন অলৌকিক কিছু মিস করেছেন। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে হরভজন সিংয়ের মন্দির প্রসঙ্গে। সিকিমের পাহাড়ি এলাকায় ভারত-চীন বর্ডারে নাথুলায় রয়েছে বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির ৷
ভারতীয় সৈন্যরা তাঁকে “নাথুলার বীর” হিসাবে সম্মানিত করেন। তাঁর সম্মানে ভারতীয় সেনারা একটি মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁকে “সন্তু” হিসাবে মানা হয় এবং বিশ্বাসীরা ওনাকে “বাবা” (সাধু) হিসাবে মানেন।
বাবা হরভজন সিং ১৯৪৬ সালের ৩০ আগস্ট সদরনা গ্রামে (বর্তমানে পাকিস্তানে) একটি শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং তিনি ১৯৬৮ সালে ভারতের পূর্ব সিকিমের নাথু লার কাছে শহীদ হন। ২২ বছর বয়সে হরভজন সিংহের মৃত্যু হয় এবং তাঁর কহিনী ধর্মীয় শ্রদ্ধার বিষয় হয়ে ওঠে।
সমুদ্র তট থেকে প্রায় ১৩০০০ ফুট উপরে বাবার মন্দির। আপনি চাইলে জুলুকে একদিন থেকে বাবা মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেন। তবে এতটাই উঁচু যে অনেকের শ্বাস কষ্ট হয়, এর জন্য আপনি কর্পূর এর ঘ্রাণ নিতে পারেন অল্প অল্প করে এবং জল পান করতে পারেন কিছু সময় অন্তর অন্তর। যাত্রা শুরু করা যেতে পারে এন জি পি থেকে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন চত্বর থেকে গাড়ি বুক করুন শেয়ারে অথবা নিজেদের মতন করে, এরপর চলে যান হৃষিখোলা। ওখানে একদিন থাকুন, তারপর যাত্রা করুন জুলুক। আরো একটি বিশেষ ব্যাপার, ওই স্থানে আপনি মোবাইল টাওয়ার পাবেন না। তাই ছবি সংগ্রহ করুন আর নির্ভেজাল প্রকৃতির আনন্দ নিন। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নেওয়ার জন্য মোক্ষম জায়গা পাহাড়।
জুলুকে একদিন রেস্ট করলেই যথেষ্ট, ব্যাস গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন থাম্ভি ভিউ পয়েন্ট, নথাং ভ্যালি, কুপূপ লেক, সিল্ক রুট এবং বাবা হরভজন সিং মন্দির। সিল্ক রুট পার করলেই খাওয়ার দোকান পেয়ে যাবেন। গরম ম্যাগী, ক্যাপাচিনো, থেকে শুরু করে ডার্ক চকোলেট পেয়ে যাবেন। একটু খেয়ে রওনা দিন মন্দিরের উদ্দেশ্যে। পথে বাথরুম পেলে আপনাকে পথেই করতে হবে এবং লজ্জা ছেড়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে হবে।
মন্দিরে যেতে যেতে যেই ঐশ্বরিক সৌন্দর্য চাক্ষুষ করতে পারবেন তা কল্পনার অতীত। পুরো একটানা গাড়ি যায়না। অনেকেই মাঝ পথে দাড়িয়ে ছবি তোলেন ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। দূর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবেন। তবে ওখানকার পরিবেশ একদম লক্ষ্মীর মতন। খুব চঞ্চল। মেঘ মাঝে মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ছুয়ে দিয়ে যায়। আপনাকে ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করতেই হবে কিচ্ছু করার নেই। তবে যেতে যেতে গাড়িতে মদ্যপান না করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ কিছুই না, বাবা হরভজন সিং মন্দির পবিত্র স্থান। আপনি আসর পর শরীর গরম করার জন্য পানীয় নিতেই পারেন। আর যদি স্বভাব ও অভ্যাস না থাকে তাতেও অসুবিধা নেই। আসলে আপনি পাহাড়কে ভালোবাসলে ও আপনাকে কাছে টেনে নেবে।
ফিরি, বাবার মন্দিরে। আজও ওই মন্দিরে ভারতীর সৈন্যরা আসেন। তাদের ডিউটি অর্ডার নেন, বাবার আশীর্বাদ নেন এবং কাজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যান। ওখানে বাবা হরভজন সিং এর প্রসাদ হিসেবে মিছরি কিসমিস পাওয়া যায়।
লোক কাহিনী ও সেনাদের কথা অনুযায়ী মৃত্যুর পরেও তিনি তার কর্তব্যে অবিচল।হরভজন সিংহ নাকি শত্রুপক্ষ থেকে আসা আগাম বিপদের ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক করেন সেনা জওয়ানদের। এছাড়াও, কোনও সেনার পোশাক সামান্যও অবিন্যস্ত থাকলে তাঁর গালে নাকি তিনি থাপ্পড় দেন।
বাবার ঘরে আজও তার ছোট্ট সিঙ্গেল খাট চাদর বালিশ দিয়ে গোছানো। পাশেই তার পুজোর ঘর, সেই ঘরে রয়েছে সিংহাসন। তাতে হনুমান জী, কৃষ্ণ এবং শিবের মূর্তি রয়েছে। এমনকি গীতা ও হনুমান চালিশা পর্যন্ত রয়েছে। এই ঠাকুর ঘরের সামনেই রয়েছে তাঁর অফিস ঘর, যেখানে চেয়ার টেবিল ও কিছু ফাইল পত্তর রয়েছে। এই ঘরে আসর অনুমতি সকলে পায়না। তবে ভাগ্য সাথে থাকলে বাবা হরভজন সিং এর ঘরে প্রবেশ করা যায়।
লোক কাহিনী অনুযায়ী তিনি একটি দুর্গম ফাঁড়ির জন্য জিনিস পত্র সরবরাহকারী ঘোড়ার একটি কলামের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় হিমবাহে ডুবে গিয়েছিলেন। তিন দিন তল্লাশির পরে তার দেহাবশেষ পাওয়া যায়। এর পিছনেও রয়েছে আরেকটি ঘটনা। তিনদিন ধরে তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি, এরপরেই তিনি নাকি স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন অন্য এক সেনা জওয়ানকে, যার নাম প্রীতম সিংহ। প্রচলিত বিশ্বাস, হরভজনের বলে দেওয়া নির্দিষ্ট স্থানেই পাওয়া গিয়েছিল তাঁর নিথর দেহ। অবশ্য,
পরবর্তীকালে তাঁর মরদেহ পুরো সামরিক সম্মান দিয়ে দাহ করা হয়েছিল। তবে আজও নাথুলাতে দুই দেশের মধ্যে পতাকা বৈঠক চলাকালীন চীনারা এবং ভারতীয়রা তাকে সম্মান জানাতে একটি চেয়ার রাখেন। এবং মৃত্যুর পরেও নাকি নিজের কর্তব্যে অবিচল এই বাবা হরভজন সিং।
*** এমন ঐশ্বরিক যাত্রার জন্য ধন্যবাদ কৃষাণু ব্যানার্জি ও পিটার বৈদ্য***
প্রতিবেদন: সুস্মিতা কুন্ডু
ছবি: পিটার বৈদ্য