Hoop Special

Basanta Chowdhury: শরীরের রাজরক্ত বদলে দিল জীবনের মোড়, কেন মহানায়ক হলেন না বসন্ত চৌধুরী!

তথাকথিত অভিজাত নীল রক্তের বাইরে বেরোলেই কি সত্যিই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় রক্ষণশীলতাকে? রক্ষণশীল রাজপুত্র কি সত্যিই ভুলতে পারেন তাঁর প্রকৃত পরিচয়? হয়তো অথবা হয়তো নয়। বড্ড দোটানা, বিতর্ক বসন্ত চৌধুরী (Basanta Chowdhury)-র জীবনাঙ্ক জুড়ে। পুরুষোচিত সৌন্দর্য, আভিজাত্য সবই তো ছিল। তাহলে মহানায়ক উত্তম কুমার (Uttam Kumar)-এর পাশে কেন তিনি হয়ে গেলেন নিষ্প্রভ? বর্তমান প্রজন্মের কাছে ‘বসন্ত চৌধুরী’ নামটি হয়তো কিছুটা অজানা। কিন্তু একসময় বাংলা সিনেমার স্বপ্ন ছিল তাঁকে ঘিরে। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর যা হয়তো লুকিয়ে রয়েছে অতীতের গর্ভে। ফ্ল্যাশব্যাকের সূত্র ধরে ফিরে যাওয়া যাক সেই সময়ে যখন জমিদারি, বনেদীয়ানা ও ইংরেজ আনুগত্যের রমরমা।

1886 সাল। হাওড়ার আন্দুলের ‘দত্তচৌধুরী’-দের কে না চেনে? কিন্তু সেই পরিবারের পুত্র হয়ে অপূর্বকৃষ্ণ দত্তচৌধুরী (Apurba Krishna Duttachowdhury)-র নিজের শর্তে বাঁচার ইচ্ছা পূর্ণ হত না। তিনি জমিদারির কৌলিন্য চাননি। চেয়েছিলেন নিজের অস্তিত্ব তৈরি করতে। নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে। তৎকালীন সময় বংশের উত্তরাধিকার ছেড়ে দেওয়া সহজ ছিল না। কঠিন পথেই হেঁটেছিলেন অপূর্বকৃষ্ণ। পরিবার থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘দত্তচৌধুরী’ পদবী থেকে ছেঁটে ফেলে দিয়েছিলেন ‘দত্ত’। আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে প্র্যাকটিস করতে পাড়ি দিয়েছিলেন নাগপুর। পরবর্তীকালে অপূর্বকৃষ্ণ চৌধুরী নাগপুরের মরিস কলেজে আইন পড়াতেন। তাঁর বংশ থিতু হল সেখানেই। তবু একবারের জন্য পূর্বপুরুষের ভিটেয় ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেননি অপূর্বকৃষ্ণ। তাঁর ‘আয়রনি’ বহন করেছিলেন প্রপৌত্র বসন্ত।

শৈশবে পিতৃহারা হয়েছিলেন বসন্ত। মরিস কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই উপার্জনের পথে আসতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু চোখে ছিল অভিনয়ের স্বপ্ন। বসন্ত নিজেও জানতেন, তিনি সুদর্শন। নায়ক হওয়ার মতো গুণ রয়েছে তাঁর মধ্যে। ফলে টাকা যোগাড় করে চড়ে বসলেন বম্বে মেল-এর থার্ড ক্লাস কামরায়। কলকাতায় নেমে কিছুই চেনেন না তখন। চাইলে সেদিনই বসন্ত আন্দুলে তাঁর পিতৃপুরুষের বিরাট প্রাসাদে যেতেই পারতেন। সেখানে কোনো অভাব ছিল না। ফলে বসন্তের পক্ষে দত্তচৌধুরী বাড়িতে থেকে বাংলা সিনেমার নায়ক হতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথাও ছিল না। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন লড়াইয়ের পথ। সাহায্য পেয়েছিলেন বন্ধু রবি দে (Robi Dey)-র। রবি বৌবাজারে কাজ করতেন। সেখানেই মাথা গোঁজার একফালি ঠাঁই জুটে গেল বসন্তর। একবেলা পাশের পাইস হোটেলে কোনওমতে খাবার খেতেন। বাকি সময় কাটত স্টুডিওয়।

নবীন ও সুদর্শন যুবক সহজেই আকর্ষণ করে নিলেন কার্তিক চট্টোপাধ্যায় (Kartik Chatterjee)-র চোখ। 1952 সালে তাঁর পরিচালনায় তৈরি সিনেমা ‘মহাপ্রস্থানের পথে’-র মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করলেন বসন্ত। দর্শকদের নজর কেড়ে নিলেন রূপ, বনেদিয়ানা, অভিনয়ের আভিজাত্যে। শুরুটা হয়তো অনেকের তুলনায় একটু সহজ ছিল তাঁর। একের পর এক ফিল্মে অভিনয় করেছেন। তালিকায় রয়েছে হিন্দি ফিল্মও। 1960 সালে মুক্তি পেয়েছিল বিমল রায় (Bimol Roy) পরিচালিত হিন্দি ফিল্ম ‘পরখ’। সাধনা (Sadhana)-র বিপরীতে হিন্দি বলয়ের দর্শকদের নজর কাড়লেন বঙ্গতনয় বসন্ত। হিন্দি ফিল্ম ‘নয়া সফর’ বসন্তর কেরিয়ারে যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য কারণ সেই সময় বাংলা সিনেমায় শুরু হয়েছে উত্তম-সুচিত্রা যুগ। ‘নয়া সফর’-এর বাংলা ভার্সন ‘নবীন যাত্রা’-য় উত্তম অভিনয় করলেও হিন্দি ‘নয়া সফর’-এ হিন্দি উচ্চারণের কারণে তাঁকে রিপ্লেস করে নেওয়া হয়েছিল বসন্তকে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সবাক চলচ্চিত্রর গন্ডি থেকে বসন্ত চৌধুরীই প্রথম অভিনেতা যিনি তৎকালীন সময় বম্বের সিনেমাজগতে সফল হয়েছিলেন।

 

View this post on Instagram

 

A post shared by $@M (@samthebestest_)

কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেন বসন্ত এত সফলতা সত্ত্বেও হঠাৎই অস্তমিত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়েছিলেন? আসলে উত্তম কুমার নিজেকে ভাঙতে পারতেন। যে কোনও চরিত্রের জন্য উপযোগী করে তুলতে পারতেন। একই নিয়মে বম্বেতে রাজ কাপুর (Raj Kapoor), দিলীপ কুমার (Dilip Kumar)-রাও চরিত্র অনুযায়ী নিজেদের তৈরি করতেন। কিন্তু বসন্ত পারেননি তাঁর বনেদি ভাবমূর্তি থেকে বেরোতে। নিজেকে নতুন করে ভেঙে গড়তে পারেননি তিনি। ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে বসন্তের নবীন হাওয়া ভাবলেও তিনি কি নিজেকে আদৌ তা ভাবতে পেরেছিলেন? নাহলে নায়ক হিসাবে সফল হওয়ার সাথে সাথেই তাঁকে কেন পেয়ে বসল সুরা, দামি সিগার ও সুখাদ্যের নেশা? কেনই বা বসন্ত অভিনয় করতে দিলেন না নিজের স্ত্রীকে?

1957 সালে বসন্ত বিয়ে করেন কবি অজিত চক্রবর্তীর পৌত্রী অলকা চক্রবর্তী (Alaka Chakraborty)-কে। অত্যন্ত গোপনে আইনত বিয়ে সারার পর হয়েছিল আনুষ্ঠানিক বিয়ে। লরেটো হাউসের ছাত্রী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)-এর স্নেহধন্যা অলকা দারুণ ছবি আঁকতেন, আবৃত্তি করতেন। চৌদ্দ বছরের ছোট অলকাকে বিয়ে করে বসন্ত ভেবেছিলেন, তাঁর স্ত্রী হয়ে থাকবেন অসূর্যম্পশ‍্যা। কিন্তু অলকা সেই ধাতের মেয়ে ছিলেন না। বিয়ের আগে থেকেই তাঁকে চিনতেন সত্যজিৎ রায় (Satyjit Ray)। ফলে ‘অপরাজিত’ ফিল্মে তিনি অলকাকে লীলার চরিত্রে নির্বাচন করেন। তখনও অলকার বিয়ে হয়নি। কিন্তু দুঃসাহসী বসন্ত শুটিং ফ্লোর থেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে হবু স্ত্রী অলকাকে। মা-বাবা ও নিজের ইচ্ছা সত্ত্বেও অভিনয় করতে পারলেন না অলকা। সত্যজিৎ রক্ষণশীল ছিলেন না। একটি মেয়ের প্রতি এই ধরনের আচরণ তাঁর খারাপ লেগেছিল। ফলে ফিল্ম থেকে বাদ দিয়েছিলেন লীলা চরিত্রটি। কিন্তু অলকা হয়তো সেদিনই কঠিন হয়ে গিয়েছিলেন মানসিক ভাবে। বসন্তকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। দুই পুত্রসন্তান সৃঞ্জয় (Srinjay Chowdhury) ও সঞ্জিত চৌধুরী (Sanjit Chowdhury)-র মা-ও হয়েছিলেন। কিন্তু অন্দরমহলে থাকার মেয়ে ছিলেন না অলকা। তিনি ইন্টিরিয়র ডিজাইনার হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। বসন্ত তাঁকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। বসন্তর মায়ের সাথেও অশান্তি শুরু হয় অলকার। সংসার টিকিয়ে রাখতে অনেক চেষ্টা করলেও পারলেন না অলকা। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল। পরবর্তীকালে অলকা একজন আর্মি অফিসারকে বিয়ে করেছিলেন। সৃঞ্জয় ও সঞ্জিতকে একাই বড় করে তুলেছেন বসন্ত।

কোথাও কি তাল কাটল? আধুনিকমনস্ক মনে করলেও হয়তো শেষ অবধি কথা বলেছিল জমিদারি রক্ত যা ছিল রক্ষণশীল। ফলে গন্ডি পেরোতে পারলেন না বসন্ত। নায়ক হিসাবে হতে পারলেন না আধুনিক। পারিবারিক জীবনেও এই কারণেই হারিয়ে ফেললেন ভালোবাসাকে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituporno Ghosh), তপন সিনহা (Tapan Sinha)-দের মতো পরিচালকদের সাথে কাজ করা পোড়খাওয়া অভিনেতার পাশাপাশি ত্রিপুরা, কোচবিহার, আরাকান সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পুরাতন রাজতন্ত্র ও প্রত্নতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ ছিলেন বসন্ত। তাঁর গণেশ মূর্তি ও মূদ্রার সংগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। ইতিহাসের বিভিন্ন বিভাগ নিয়ে তিনি লিখতেন দেশ-বিদেশের পত্রিকায়। পুরানো কলকাতা সম্পর্কিত অগাধ জ্ঞানের কারণেই হয়েছিলেন কলকাতার শেরিফ। দুষ্প্রাপ্য বই ও ডাকটিকিটের পাশাপাশি বসন্ত পছন্দ করতেন কাশ্মীরি ও পার্শিয়ান শাল সংগ্রহ করতে। তাঁর শালের সংগ্রহ সত্যজিৎ-এর অত্যন্ত পছন্দ ছিল। ফলে তিনি নিজের বিভিন্ন সিনেমায় এই সংগ্রহ ব্যবহার করেছেন। এমনকি ইতিহাস নিয়ে গবেষণার স্বার্থেই যাত্রায় এসেছিলেন বসন্ত। যাত্রা মঞ্চস্থ করার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেতে হত। ফলে বিভিন্ন স্থানের পুরানো মন্দির, সেই স্থানের ইতিহাস সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন বসন্ত। এছাড়াও তিনি ছিলেন কলকাতা জাদুঘরের ট্রাস্টি। সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পাশাপাশি অনায়াসেই অলঙ্কৃত করেছিলেন নন্দনের চেয়ারম্যানের পদ। ছিলেন ঢাকার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বৈদগ্ধতা ও পান্ডিত্য বসন্তকে দিয়েছিল আত্মবিশ্বাস।

কিন্তু জীবন সায়াহ্নে শোধ নিয়েছিল সিগারের নেশা। ক্যান্সার ধরা পড়েছিল ফুসফুসে। জানতেন, এই পৃথিবীতে আর বেশি দিন সময় নেই। প্রাণাধিক প্রিয় দুর্লভ গণেশ মূর্তির সংগ্রহ বসন্ত দান করে দিলেন ভারতীয় জাদুঘরে। 2000 সালের 20 শে জুন রানিকুঠীর বাড়িতে এক বৃষ্টিভেজা ভোরে প্রয়াত হলেন আন্দুলের দত্তচৌধুরী বংশের ষোড়শ পুরুষ। না, এই পরিচয় তাঁর জীবদ্দশায় ইন্ডাস্ট্রিকে দিতে চাননি তিনি। কিন্তু কিভাবে যেন সকলে জেনে গিয়েছিলেন। তবে তা নিয়ে অহংবোধ ছিল না বসন্তর। শেষ ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী, সকলের অজ্ঞাতসারে সৃঞ্জয় ও সঞ্জিত পিতার সৎকার করেছিলেন। পারলৌকিক কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন বসন্ত। বর্তমান টলিউড অজানা কারণে ছিল বসন্তবিমুখ। শেষের দিকে স্টুডিওতে যেতেন না বসন্ত। হয়তো অজ্ঞাতে সৎকারের পথে গিয়েই টলিউডকে সেই অবহেলা ফেরত দিয়ে গেলেন রাজরক্তের ধারক বসন্ত চৌধুরী।