” সারা জীবনের মতো একবারই এই মৃত্যুসাজ………
এতদিন প্রাণ ছিল। অমরত্ব শুরু হলো আজ।” কবি শ্রীজাত’র কলম ধরেই শুরু হোক এই লেখা। ২০২০ যে এমন দিন দেখাবে তা কেউই স্বপ্নে ভাবতে পারেনি। ২০১৯ এর বর্ষ শেষে সকলের মনে ছিল উদ্দীপনা, এক রাশ বেঁচে থাকার স্বপ্ন আর বাঁচিয়ে রাখার প্রেরণা। নামী-বেনামী বহু প্রাণ এই বছর হারিয়ে গেছে। হয়তো আমার পাশের বাড়ির কেউ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু, আজ আমরা কথা বলব সেই মানুষদের নিয়ে যারা শুধুমাত্র টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে কাজ করেছেন এবং এই বছর যারা অমরত্ব পেয়েছেন।
তাপস পাল – ১৯৮০ সালে জীবনের প্রথম বাংলা সিনেমা ‘দাদার কীর্তি’ তে অভিনয় করেই বাঙালির মন জয় করে নেন তাপস পাল। এরপর ১৯৮১ সালে করেন ‘সাহেব’। একটা সময় প্রসেনঞ্জিৎ আর তাপস পাল ছিলেন বাংলা সিনেমার হিরোদের মধ্যে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। ‘চ্যালেঞ্জ ২’ হোক বা ‘মন মানে না’ সবেতেই দুর্দান্ত ফিট ছিলেন প্রয়াত তাপস পাল। এমনকি বলিউড অভিনেত্রী ১৯৮৪-তে মাধুরীর বিপরীতে ‘অবোধ’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।
হ্যাঁ, এই বিষ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৬১ তেই অমরত্বের শিরোপা পান তিনি। অভিনয় জীবন ছাড়াও তাঁর রাজনৈতিক জীবন পরিদরশন করলে পাওয়া যায়- ২০০১ সালে আলিপুরে তৃণমূলের টিকিটে ভোটে জিতে প্রথম বিধায়ক হন তাপস পাল। ২০০৬ সালে আলিপুর কেন্দ্রে ফের সাফল্য পান তিনি। এরপর, ২০০৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে লোকসভা নির্বাচনে জিতে সাংসদ হন তাপস পাল। রোজভ্যালিকাণ্ডে প্রায় ১৩ মাস জেলবন্দি ছিলেন তাপস পাল। এরপর তাঁকে আর রাজনীতির মঞ্চে দেখা যায়নি। তখন থেকেই অসুস্থ হয়ে যান তিনি। প্রসঙ্গত, একবার একটি নির্বাচনী প্রচার সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তাপস পাল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। নিজেকে “চন্দননগরের মাল” বলে পরিচয় দেন এবং জানান যে তিনি পকেটে “মাল” নিয়ে ঘুরে বেড়ান। এই নিয়ে শুরু হয় ব্যপক বিতর্ক। শেষে তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চান।
সন্তু মুখোপাধ্যায় – অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের বাবা হলেন অভিনেতা সন্তু মুখোপাধ্যায়। বড়পর্দার পাশাপাশি ছোটপর্দাতেও দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গিয়েছেন সন্তু। তপন সিংহের ‘রাজা’ ছবি দিয়ে তাঁর বড়পর্দায় অভিষেক হয়। ‘গণদেবতা’, ‘দেবদাস’, ‘মালঞ্চ’, ‘হেমন্তের পাখি’ সহ বহু বাংলা সিনেমায় তাঁকে দেখা গিয়েছে। বড় পর্দায় কাজ করা ছাড়াও ‘কুসুমদোলা’, ‘অন্দরমহল’, ‘জল নূপুর’ ‘ইষ্টিকুটুম’ ধারাবাহিকেও দেখা যেত সন্তু মুখোপাধ্যায়কে। শেষে এই বিষ বছরের ১১ই মার্চ দক্ষিণ কলকাতার নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জানা যায় যে, দীর্ঘদিন ধরে ব্লাডসুগার ও হাইপারটেনশনের রোগী ছিলেন সন্তু এবং সেই সঙ্গে চলছিল ক্যানসারের চিকিৎসাও। শেষে সন্তুও পান অমরত্বের শিরোপা।
শর্বরী দত্ত – পুরুষদের ফ্যাশনের প্রথম পছন্দ ছিলেন শর্বরী দত্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘শূন্য’ সবসময় ভরে ওঠে পুরুষদের এথনিক কালেকশনে। পুরুষদের জন্য এনেছিলেন রঙিন ও বাহারি ধুতি পাঞ্জাবীর ইউনিক কালেকশন। মিশরীয় সভ্যতার ছবি থেকে মধুবনী, যামিনী রায়–দেশ বিদেশের সংস্কৃতিকে পুরুষদের ফ্যাশনের সঙ্গে নিপুণ হস্তে বুনন করেছিলেন তিনি। অনেক অভিনেতাই তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানে সেজেছেন শর্বরী দত্তের ফ্যাশনে। কিন্তু একী হল! নিজের শৌচাগারেই মিলল তাঁর নিথর দেহ। মাত্র ৬৩-বছর বয়সে বিদাই নেন তিনি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, মস্তিষ্কে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে ফ্যাশন ডিজাইনার শর্বরী দত্তের। ফ্যাশন দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলা এই বর্ষীয়ান ডিজাইনার অমরত্বের শিরোপা পান বিষ বছরের সেপ্টেম্বরের ১৬ অথবা ১৭ তারিখে। কারণ, পরিবার সূত্রে খবর ও ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৩৬ ঘণ্টা শৌচাগারেই ছিলেন নিথর শরীরে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় – অপুকে হারিয়েছে বাঙালি ২০২০ র ১৫ ই নভেম্বর। টালিগঞ্জের মহীরুহ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বহুদিন লড়াই চালান জীবনের সঙ্গে। উত্তম সমসাময়িক যুগেও তিনি তাঁর আলাদা পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে তাঁর প্রথম কাজ। সত্যজিৎ রায় ছাড়াও তিনি তপন সিংহের পরিচালনায় ক্ষুধিত পাষাণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অজয় করের পরিচালনায় সূচিত্রা সেনের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এমনকি উত্তম কুমারের সঙ্গে ঝিন্দের বন্দি চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মন টেনে নেন নিজের দিকে। এই বিষ বছরে তিনিও অমরত্বের শিরোপা টান। করোনা মুক্ত হলেও, কোভিড পরবর্তী শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন সৌমিত্রবাবু। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
মনু মুখপাধ্যায়– ৯০ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন শেষে এই বিষ বছরের ৬ ডিসেম্বর অমরত্বের শিরোপা পান বর্ষীয়ান ও মাজাদার অভিনেতা মনু মুখোপাধ্যায়। তাঁকে মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নিচে’ অভিনয় করতে দেখা যায়। এছাড়াও, ‘গণদেবতা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’,’দাদার কীর্তি’, ‘সাহেব’, ‘শ্বেত পাথরের থালা’, ‘গণশত্রু’, ‘পাতালঘর’, ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ সহ অগণিত বাংলা সিনেমায় তাঁকে দেখা গিয়েছে। হৃদযন্ত্রের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। শেষে ৬ ডিসেম্বর বিদাই নেন তিনি।
২০২০ র মৃত্যু মিছিলে টলিউডের পাশাপাশি বলিউডেও অনেক নক্ষত্রপতন হয়েছে কিন্তু আমাদের আজকের বিষয় ছিল টলিউডের মৃত্যু মিছিলের কাহিনী।