Hoop Special

আজকের গল্প: মা মেয়ের বন্ধুত্ব « অর্পিতা বসু

ঘুমপাড়ানি গান থেকে শুরু করে মা তার স্মৃতির পাতা উলটে ঠাকুরমার ঝুলি, রাজকন্যা, পরী, দৈত্য- এমন সব হাজারো গল্প বলে যান তার মিষ্টি মেয়েকে। মায়ের এই মমতার বলয়ে মেয়ে তৈরি করে নেয় নিজের কল্পলোকের এক সুন্দর স্বপ্নপুরী। সেই স্বপ্নপুরীতে নির্ভয়ে, আনন্দে, নিঃসঙ্কোচে বড় হতে থাকে মায়ের রাজকন্যা। এই রাজকন্যার সকল সমস্যার সমাধান এক নিমিষেই করে দেন মা। মায়ের আছে  মায়ার যাদু। তেমনই আজ শোনাবো টিনা আর সোনালীর দুষ্টু মিষ্টি গল্প।

টিনার বয়স এখন ২২ বছর। এখনো টিনা ঘুম থেকে উঠে মায়ের সাথে দু-দন্ড কথা না বলে থাকতে পারেনা। এদিকে সোনালীর বয়স ৪৭, তিনিও নিজের মেয়ের সাথে সারাদিন হাজারো কথা কাটাকাটি হলেও মেয়ে ছাড়া কিচ্ছুটি বোঝেননা। সক্কাল সক্কাল টিনার হাতে এক কাপ চা না খেলে সোনালীর দিন শুরু হয় না। আর টিনা সকাল ৭টা থেকে ৮টা অব্দি মাকে থাইরয়েড আর গ্যাসের ওষুধ খাওয়ানোর পিছনে ছোটে। আর সোনালী কোনো ওষুধ না খেয়েই প্রতিদিন নারায়ণকে খাওয়ানো নিয়ে বেজায় ব্যস্ত।

যখন টিনা ছোট ছিল তখন মেয়েকে ভাত না খাইয়ে স্কুল যেতে দিতেননা। এখানেই শেষ নয় স্কুল যাওয়ার পথে মেয়ে ঠিক করে স্কুলে পৌছেছে কিনা তা জানার জন্য সিকিউরিটি গার্ডকে ১০ঃ৪৫ এ ফোন করতেন। যদি একদিন সিকিউরিটি না থাকতো তাহলে সোনালী নিজে স্কুলে এসেই হাজির হতেন মেয়ের চিন্তায়। এতে অবশ্য টিনা লজ্জা পেতনা। বরং বেশ খুশি হত। যদিও মাঝে মাঝে মায়ের কান্ডকারখানায় সে ভীষণ রেগে যেত। মেয়ে এখন কলেজে পড়ে তবু মেয়ের চিন্তায় বেশ মগ্ন থাকেন সোনালী। এখনো কলেজে মেয়েকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েই পাঠান।

আগেকার মতো দিন আর নেই। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে মানুষের সাথে যোগাযোগ করা যায়। সোনালী একটু সেকেলে হলেও এখনকার যুগের সাথে তাল মেলাতে শিখে নিয়েছে। তাই তো মেয়ের খবরদারি রাখার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সক্রিয়। টিনা স্মোক, ড্রিংক সব করে তা অবশ্য সোনালী জানতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ার থেকেই। প্রথমে এসবে আপত্তি থাকলেও, ঝগড়া ঝামেলা করলেও এখন আর এসবে কোনো আপত্তি নেই। এখন মায়ের দাবি মেয়ে ঘরে বসে বন্ধুদের সাথে পার্টি করুক। আপত্তি মেয়ে রাস্তার ধারে বা পাবে বসে মদ খাক। সোনালী সর্বদা মেয়েকে সব কিছুতে সার্পোট করলেও মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় থাকতো। নিজের ছোট্ট সংসার নিয়ে, স্বামী ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিল সোনালী।

মা-বাবা-ভাই এই নিয়ে ছোট্ট পরিবার ছিল টিনার, তবে হঠাৎই এক ঝড় বয়ে যায় সুখের সংসারে। টিনার দাদা অর্ণব সর্বদা টিনাকে শত্রু মনে করতো কিন্তু টিনা ওর দাদাকে খুব ভালোবাসতো। হঠাৎ টিনার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়। এইসময় অর্ণব সব দায়িত্ব থেকে এড়িয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে থাকতে শুরু করে। বাবা ক্রমশ আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন টিনার ওপরই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে। আগে টিনা দায়িত্ব কি জিনিস তা জানতো না, তখন এই ডানপিটে মেয়েকে শান্ত হয়ে সামলাতে হয় সবটুকু। ওর মা তা মেনে নিতে পারেন না। ভেঙে যায় পরিবারটি। নেমে আসে অন্ধকার।

দায়িত্বের কথা শুনে অর্ণব আলাদা হয়। টিনা তখন বাড়িতে মায়ের সঙ্গেই একা থাকতে শুরু করে। বাবার চিকিৎসা তখনও চলছে। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। মা-মেয়ে সংসারের হাল ধরে। মায়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে টিনা। নিজের কষ্ট আড়াল করে মাকে মানসিক শক্তি জোগায়। আস্তে আস্তে বাসুদেব বাবু (টিনার বাবা) বাড়ি ফেরেন। বাসুদেবের ছেলের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস যা ছিল তা নিমিষেই কেটে যায়। টিনাই তখন বাড়ির কাজ ও সাথে বাইরের কাজে একা সামাল দেয়। বাড়িতে মা বাবাকে সাহস দেয়। সেই সময় মা খুব কষ্টে ছিল ছেলের‌ এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখে। সোনালি কখনো টিনা আর অর্ণবকে আলাদা করে দেখেননি।

যদিও টিনা কি করলে মায়ের ভালো লাগবে, সেই নিয়েই সময় ভাবে। মা কখনো যেন একাকিত্বে না ভোগেন, সে জন্য সবটুকু সময় টিনা তাকেই দেয়। শ্রাবণীর মাও একই রকম ভাবেন। তিনি বলেন, ‘জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ে আমার মেয়েটি সাহস জুগিয়েছে। যেকোনো সমস্যায় তার সঙ্গে আলোচনা করেছি। সহজেই সমাধান বের করে ফেলেছি। মেয়েই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। সব সময় চেয়েছি মেয়েকে যেন বন্ধুর মতো করে বড় করতে পারি। কতটুকু পেরেছি, তা আজ বুঝতে পারছি। আমাকে কোনো কষ্টই বুঝতে দেয় না। এমন বন্ধু কি সহজে মেলে? দুজন দুজনকে প্রতিটি কাজে অনুপ্রেরণা দিই। সবকিছুই ওর সঙ্গে শেয়ার করি। এমন বন্ধু পেলে যেকোনো দুঃখই সহজে জয় করা যায়।’ এখন বাসুদেব অনেকটাই সুস্থ। আর টিনাই বাবা মায়ের ভরসা। অনেকে ভাবতো টিনা মদ সিগারেট খেয়ে বকে গেছে। কিন্তু টিনা যতই মা বাবার সাথে খুনসুটি করুক দিনের শেষে মেয়েকে তাদের চাই।

[সমাপ্ত]
গল্প: অর্পিতা বসু
পোস্টার ডিজাইন: কৌশিক ব্যানার্জি

(গল্প কেমন লাগল জানাতে অবশ্যই ভুলবেন না। ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন।
***এবার থেকে গল্প পাঠাতে পারেন আপনিও। আপনার লেখা গল্প সরাসরি পাঠিয়ে দিন আমাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। মৌলিক ও অপ্রকাশিত গল্প সর্বদা গ্রহণযোগ্য হবে। গল্প নির্বাচিত হলে অবশ্যই প্রকাশিত করা হবে প্রতি শনি ও রবিবার।***)

Related Articles