Hoop Story

Kolkata Puja: থিমের পুজোর চাকচিক্য নয়, দেখে নিন মতিলাল শীলের বনেদিবাড়ির পুজো

কলকাতা মানেই এখন বড় বড় পুজোগুলো থিম পুজোর আয়োজন করে, কিন্তু আসল যে বনেদিয়ানার পুজো সেগুলো কিন্তু কোন অংশে কম যায় না। এখানে হয়তো তেমনি অত বেশি বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু লম্বা লাল দালান আর ডাকের সাজে দুর্গা কিন্তু অন্য এক ঐতিহ্য বহন করে । আজকে কথা বলব কলকাতার যে কটি বনেদি বাড়ির পুজো হয়, তার মধ্যে অসাধারণ একটি পুজো মতিলাল শীলের পারিবারিক পুজো নিয়ে।

প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই পুজো এখনো কিন্তু সব মহিমায় তার স্থানেই বিরাজ করছে। থিম নিয়ে যতই বাড়াবাড়ি হোক না কেন একবার হলেও এই বাড়ির পুজো দেখতে মানুষ কিন্তু আসেন এখনো। কলুটোলা শিল্প পরিবারের জমিদার ছিলেন স্বনামধন্য মতিলাল শীল। তিনি খুব পরোপকারী মানুষ ছিলেন, মানুষের সেবা করতে ভালোবাসতেন। তার সময় থেকেই শীল বাড়ির এই দুর্গা পূজা শুরু হয়।

সেন্ট্রাল এভিনিউ মেট্রো স্টেশনে নেমে অথবা বাসে করে কলুটোলা স্টপেজে নেমে একটু হাঁটলেই ডান দিকে পড়বে মতিশীলের বাড়ি। এ বাড়ির কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত নিয়ম আছে, অষ্টমী পূজোর পর বাড়ির মেয়েদের দিয়ে এখানে ধুনো পোড়ানো হয়। তাছাড়া ষষ্ঠীতে মায়ের হাতে অস্ত্র ওঠে।

প্রায় দুশো বছর ধরে একনাগাড়ে এই বাড়ির পুজো বজায় আছে। কোনদিন কোন কারনেই বন্ধ হয়নি, বাড়িতে প্রথমে ঢুকতেই দেখতে পারবেন বিশাল দালান। আর সেই দালানের চারপাশে সুন্দর করে সাজানো হয় দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে। দালানের সামনেই রয়েছে দুর্গা মন্ডপ। বারান্দা লাগোয়া ঘর আছে। ঘরের পরতে পরতে রয়েছে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া।

উল্টো রথের দিন শীল বাড়ির পুজোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এদিনই গরান কাঠের কাঠামো পুজো হয়। এখানকার পুরোহিত আর যিনি প্রতিমা তৈরি করেন, তারা দুজনেই কিন্তু বংশপরম্পরায় কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাই কলকাতায় ঠাকুর দেখতে গেলে অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন অসাধারণ এই বনেদি পূজোয়।

মতিলাল শীল একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি কলকাতার একজন বিশিষ্ট মানুষ ছিলেন বটে। তার জমিদারি ছিল বাগনান, মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা এমনকি বাংলাদেশেও। আপাতত এই বাড়িতে এখন চার শরিক থাকেন, তাদের সকলেরই পদবী মল্লিক। মতিলাল শীল এর ছোট ছেলে কানাইলাল শীল আপাতত এখন এই বাড়িতেই থাকেন। কানাইলালের ছেলে গোপাল লালের দুই কন্যা। পুত্র সন্তান যেহেতু ছিল না তার ভাগ্নীরা সম্পত্তি পেয়ে যান আর তারপর থেকেই এই পুজো হয়ে আসছে।

প্রতিবছর লক্ষাদিক টাকা খরচা করে ধুমধাম করে পুজো হয়, এছাড়া মহিলাদের পোশাকেও থাকে, কিন্তু বেশ একটু নতুনত্বের ছোঁয়া। মহালয়ার পর অর্থাৎ প্রতিপদের দিন ঘট প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপরে ঘট নিয়ে চলে যাওয়া হয় বোধনের জন্য, বোধন ঘরে। আর সেখানেই পুজো চলতে থাকে। যেখানে ঠাকুর রাখা হয় অর্থাৎ দালানে ঘট আনা হয় দেবী মূর্তির সামনে রাখা হয়। এখানকার নিয়ম অনুযায়ী বেল গাছকে দেবী রূপে পূজা করা হয়।

শীলেদের পুজোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সন্ধিপোজক। এই পুজোয় চাল কুমড়োকে বলি দেওয়া হয়। তারপর অষ্টমীর দিন মেয়েরা ধুনো পোড়ান এবং নবমীর দিন করা হয় ব্রাহ্মণ বিদায়। বিদায় ব্রাহ্মণদের দেওয়া হয় ভোগের প্যাকেট আর ৫০ টাকা।

এই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় মতিলাল শীলের নামাঙ্কিত একটি ঘাট স্ট্র‍্যান্ড রোড অবস্থিত সেখানে। শুধু যে গিয়ে দেবীকে জলে ফেলে দেওয়া হয়, এমনটা কিন্তু নয়, তার আগে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানো হয়। এই নীলকন্ঠ পাখি আগে কৈলাসে গিয়ে খবর দেবেন, যে মা আসছেন তারপরে মাকে জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে নীলকণ্ঠ পাখিকে ওড়ানো নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে এখন আর সেই রীতি পালন করা হয় না।

তবে পুরনো নিয়মের কিছুটা রদবদল ঘটে উঠেছে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যখন ভয়ঙ্কর দাঙ্গা বাধে, তার আগে পর্যন্ত কাঁধে করে বিসর্জন ঘাটে নিয়ে যাওয়া হতো প্রতিমাকে। তবে তারপর থেকে কাঁধে করে নিয়ে যাবার চল বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ঐতিহ্য সাবেকিয়ানার ইতিহাস সব নিয়ে এখনও দিব্যিই স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছি মতিলাল শীলের এই পুজো।

দর্শক হিসেবে আমাদেরও উচিত বনেদি পূজোর ঠাকুর দেখতে যাওয়া। কারণ সবাই যদি থিমের পুজোর দিকে ছোট তাহলে এই পুজোগুলো কিন্তু কোথাও গিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে, এই পুজোগুলি শুধুমাত্র যে দুর্গা পুজো বা কোন উৎসবটা কিন্তু নয়, অনেক ইতিহাস এবং অনেক ঐতিহ্যকে বহন করে, তাই আমাদের এবং আমাদের উচিত নতুন প্রজন্মকে সাথে নিয়ে এই ঠাকুরগুলো দেখা।

Related Articles