ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের জুটি সেইসময় লোকের মুখে মুখে প্রচার হত।তাঁদের জুটি এতটাই হিট ছিল যে পরিচালকদের সেই ছবির বক্স অফিস নিয়ে চিন্তা করতে হত না। স্বপন সাহার ‘সুজনসখী’ ছবিতে দুজনের অভিনয় মানুষ ব্যাপকহারে পছন্দ করে। এই ছবি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পরপর অনেক কাজ তারা জুটি হিসাবে একসঙ্গে করেন। বড় পর্দার নায়ক-নায়িকা রূপে এখনও সমানতালে কাজ করছেন প্রসেনজিৎ এবং ঋতুপর্ণা। কোথাও যেন ইঁদুর দৌড়ের মাঝখানে বড় পর্দা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। তার এই লাইমলাইট থেকে সরে আসার কারণ হিসেবে তিনি এই জুটিকেই দোষী বলেছিলেন।
দীর্ঘদিনের সতীর্থ অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের এই অকালপ্রয়াণে প্রতিক্রিয়া জানান ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত একটি সংবাদমাধ্যমকে। তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এ খবর কি মিথ্যে হতে পারে না? আসলে, পর পর এত মৃত্যু দেখছি, কী আর বলব। তবে কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না অভিষেকের মৃত্যুটা। অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের অবদান বাংলা সিনেমায় প্রচুর। অনেক ছবি করেছি ওর সঙ্গে। আমার জীবনের কিছু শ্রেষ্ঠ ছবি অভিষেকের সঙ্গেই। এখনও মনে আছে অভিষেক আর আমার সুজনসখী তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। এই ছবি আমার কেরিয়ারের প্রথম দিকের ছবি। শুধু কী তাই, যে ছবিটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’। যে ছবিটার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। সেই ছবিতেও তো অনেকটা জুড়ে ছিল অভিষেক। ঋতুদা আমাকে বলেছিল, অভিষেক আমার খুব প্রশংসা করেছে। এরকমই মানুষ ছিলেন তিনি। মন খুলে কথা বলতেন। প্রচুর আড্ডা দিয়েছি একসঙ্গে। সব মনে পড়ে যাচ্ছে।”
ঋতুপর্ণা জানান যে যখন বাংলা ইন্ডাস্ট্রি খারাপ সময়ের মধ্যে যাচ্ছে তখন অভিষেক চট্টোপাধ্যায় একমাত্র হাল ধরেন। তিনি অকপটে স্বীকার করে নেন যে এই ইন্ডাস্ট্রি প্রতি তার অনেক ক্ষোভ এবং অভিমান ছিল। যদিও সেই সকল জিনিস নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এখন তিনি আর কামনা করেন না।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার রেষারেষি বহুদিনের। একথা ইন্ডাস্ট্রিতে কান পাতলেই শোনা যেত। অভিষেক চট্টোপাধ্যায় অভিযোগ তোলেন যে শুধুমাত্র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের রাজনীতির শিকার হয়ে তাঁকে ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। একটি সংবাদমাধ্যমকে তার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘প্রতিক্রিয়া দেওয়ার অবস্থাতে নেই। ওর বরকর্তা হয়েছিলাম আমি। সব মনে পড়ছে। ওর সঙ্গে ভাল স্মৃতিগুলোই মনে রাখতে চাই।’
২০১৭ সালে তিনি যখন দীর্ঘ বিরতির পর ছোটপর্দায় কামব্যাক করেন তখন একটি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির উপর বিস্ফোরক অভিযোগ তোলেন। সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি, “এত বুড়ো হয়ে যাইনি যে, দেব কিংবা জিতের বাবার চরিত্রে অভিনয় করব। এখনও মুম্বইতে আমির, শাহরুখ, সলমন, অক্ষয়দের তো নায়ক হিসেবে দেখা যাচ্ছে। আসলে এখানে প্রতিভার চেয়ে তেলবাজিটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সময়কার কেউ কেউ তেল দিয়ে এখনও কাজ করছে। সেটা আমি পারব না। আমি কাউকে পরোয়া করি না।আমি সকালবেলা তেলের টিন নিয়ে বেরোই না। পিআর-ও খুব খারাপ। তার উপর স্পষ্টবক্তা। যাকে পছন্দ নয়, তার মুখের উপর জবাব দিতে আমি কুণ্ঠিত নই। যা পলিটিক্স করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে।”
তিনি সেই রাজনীতির অভিযোগ স্পষ্টভাবেই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দিকেই তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,“৯৭-৯৮ সালে এরা জোট বেঁধে প্রায় ৩০-৩২টা ছবি থেকে আমাকে বাদ দিয়েছিল। সে সময়ে আমিই টলিউডে এক নম্বর। প্রায় এক বছর আমার কোনও কাজ ছিল না। বসে থেকে থেকে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। বছর দুয়েক পরে যাত্রায় যোগ দিলাম। তার পরই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন শুনেছি, লোকে বলছে, ‘অভিষেক তো ফুরিয়ে গিয়েছে’। এ সব শুনে কষ্ট হত। কিন্তু আমি প্রত্যয়ী ছিলাম। ”
এখন তিনি এইসব বিতর্কের অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করছেন। গতকাল রাতেই তিনি পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছে শোকসন্তপ্ত গোটা টলিউড ইন্ডাস্ট্রি।