সবে মাত্র সন্ধ্যে গড়িয়েছে। আকাশে তারারা উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎই সন্ধ্যা তারাখানা খসে পড়ল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সুরমহল ছেড়ে পাড়ি দিলেন সুরলোকে। তিনি ছিলেন গীতশ্রী, তিনিই বঙ্গ বিভূষণ। স্বর্ণযুগের মান্না দে , হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো অসংখ্য কিংবদন্তি সংগীত স্রষ্টার জন্মস্থান বাংলা। সন্ধ্যা দেবীই ছিলেন সেযুগের শেষ প্রতিনিধি, তিনিও বিলীন হয়ে গেলেন মহাশূন্যে। তিনি এতটাই উদার ছিলেন যে সুর-বেসুর সবাইকেই গানে করার উৎসাহ দিতেন।
প্রসঙ্গত, মাত্র ষোলো বছর বয়সে সন্ধ্যা দেবীর মামস রোগ হয়। দুটি কানও সেই কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ডান কানে একেবারেই শুনতে পেতেন না। অথচ সংগীত পরিচালকের নির্দেশ শোনা, নিজেরই গানের ছন্দ বোঝা, এসব করতেন কিভাবে! অতুলনীয় ছিল তাঁর পদ্ধতি। দুই কানকে ব্যালেন্স সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলার সম্রাজ্ঞী হয়ে সিংহাসন দখল করে ফেলেছিলেন দেবী। তিনি ইন্টারভিউ-এর পক্ষপাতী ছিলেন না। এসব সোশ্যাল যোগাযোগের বাইরেই থাকাটা পছন্দ ছিল তাঁর। সুচিত্রা সেনের মতোই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “বাণিজ্য বা সাফল্য নিয়ে ভাবিনা। আমি শুধু গান আঁকড়ে বাঁচতে চাই।”
দিনটি ছিল ২৫ জানুয়ারি। ৪:৩০টের সময় একটি ফোন বেজে উঠল। ‘পদ্মশ্রী’ নেওয়ার আবেদন জানালো বিপরীতের মানুষটা। ১৫ মিনিট পর আবার কল ব্যাক গেল ওই আবেদনকারীর কাছে। স্বাভিমানে ভরে উঠেছে এক বৃদ্ধার স্বর। শোনা গেল ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। অনেক কথা উঠল, শেষ বয়সে এসেও অনেক ট্রোল হতে হলো সন্ধ্যা দেবীকে। রাজনৈতিক রং লাগানোরও চেষ্টা চলল বেশ কিছু দিন ধরে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। দেবীর সিংহাসন বজায় রইল। এত শোরগোলের মধ্য থেকে উঠে এলো একটাই প্রশ্ন, “ফোন টা কার ছিল?”
সন্ধ্যা দেবী ও লতাজির বেশ বন্ধুত্ব ছিল।সন্ধ্যা দেবীর হাসপাতালে ভর্তির খবর জানানো হয়নি লতাজিকে পাছে তাঁর অসুস্থতা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু দেখা গেল লতাজির যাওয়ার পরই সন্ধ্যা দেবীর বিদায়ী। শোনা যায়, লতাজির মতোই ছিলেন সন্ধা দেবী। জীবনে কোনোরকম আড়ম্বরই ছিল না।পুরোনো যুগের মানুষ তো! ওঁরা গানের সাধিকা ছিলেন বলা যায়। সঙ্গীতেই ওঁদের জীবন-মরণ সীমাবদ্ধ। তাই তো এত যুগ পরেও সে কি অপূর্ব কন্ঠস্বর! শিল্পী-শরীরের বয়স হতে পারে কিন্তু শিল্পীমনের তো আর বয়স বলে কিছু হয়না। তাই না?