Hoop Story

Sudipa Chatterjee: পূজোয় প্রতিদিন বদলে যায় বাড়ির ‘জাগ্রত’ দেবী মায়ের মুখের আদল!

পরিচালক অগ্নিদেব চ্যাটার্জি (Agnidev Chatterjee)-র পারিবারিক দুর্গাপুজো বহুদিনের ঐতিহ্যবাহী পুজো। চট্টোপাধ্যায় বাড়ির মা দুর্গাকে ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনী। অস্ত্রসজ্জাতেও রয়েছে রদবদল। এবার বাড়ির মা দুর্গার সামগ্রিক ছবি তুলে ধরেছেন চট্টোপাধ্যায় বাড়ির বৌ ও রান্নাঘরের ‘রানী’ সুদীপা চ্যাটার্জি (Sudipa Chatterjee)।

সুদীপা জানালেন, রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো দিয়ে সূত্রপাত হয়। পঞ্চমীর দিন মা দুর্গার নিমন্ত্রণ অধিবাস মানেই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোর হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। ষষ্ঠীতে বোধনের ঘট বসে। করোনার কারণে গত বছর থেকে সপ্তমীর দিনে গঙ্গায় নবপত্রিকা স্নান বন্ধ রয়েছে। গঙ্গার জল ঘড়ায় করে নিয়ে এসে বাড়ির ছোট ছাদে নবপত্রিকা স্নান সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চট্টোপাধ্যায় পরিবারে তিনটি মতে মা দুর্গার পুজো হয়। পঞ্চমী থেকে সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ পর্যন্ত বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, দেবাদিদেব মহাদেব একদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি আসেন। তাই ওই দিন পুজোর রীতি বদলে হয় শৈব মতে। সন্ধিপুজার বলি হওয়ার পর থেকে তন্ত্র মতে পুজো হয়। পারিবারিক পুজোর এই রীতির নাম ত্রিধারা। এই রীতি কলকাতার সুপ্রাচীন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ও চট্টোপাধ্যায় পরিবারে পালিত হয়।

চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোর ভোগ একটু অন্যরকম। বাংলাদেশের ঢাকায় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি। ফলে মায়ের পুজোয় ঢাকা থেকে চিনিগুঁড়া চাল ও গাওয়া ঘি আসে। দেবীকে একেক দিন একেক রকম চালের ভোগ নিবেদন করা হয়। ষষ্ঠী বা সপ্তমীতে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে ভোগ রান্না হয়। অষ্টমীর দিন মাকে নিবেদন করা হয় চিনিগুঁড়া চালের অন্ন। এছাড়াও লুচি-মিষ্টি ভোগ হয়। পুজোর কয়েকটা দিন মা দুর্গাকে ছানার মিষ্টি দেওয়া হয় না। নিবেদন করা হয় ক্ষীরের মিষ্টি। নবমীতে ভোগ তৈরি হয় তুলাইপাঞ্জি চাল দিয়ে। এদিন হয় দেবীর মহাভোগ। তাতে থাকে সাত-আট রকমের মাছ, নিরামিষ মাংস, শুক্তো, পায়েস। দশমীতে দেবীকে পান্তাভাত নিবেদন করা হয় দশকাঠি সিদ্ধ চাল দিয়ে। পান্তাভাতের সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা, কচুর শাক, শাপলার টক। পরিবারের ছেলে-মেয়েরা কাপড়ে মুখ বেঁধে, দুর্গানাম জপতে জপতে মা দুর্গার ভোগ রান্না করেন। তবে সেই সময় ইশারায় কথা বলা যায়। রান্নার পর বাড়ির পুরুষরা পায়েস এবং ভোগ নিবেদন করেন। নবমী ও দশমীতে মাছ খাওয়া হয়। নবমীতে মা দুর্গাকে পদ্মার ইলিশ ভোগ দেওয়া হয়। দশমীর দিন গঙ্গার ইলিশ খাইয়ে ঘরের মেয়ে উমাকে চোখের জলে বিদায় জানান পুরো পরিবার। এরপর সরস্বতী পুজোর সময় আবার পরিবারে ইলিশ রান্না হয়।

সুদীপা জানিয়েছেন, চট্টোপাধ্যায় পরিবারের মা দুর্গার সাজে রয়েছে বিশেষত্ব। ষষ্ঠীতে মাকে আপেল দিয়ে তৈরি ফলের মালা পরানো হয়। মালাটি থাকে দশমী পর্যন্ত। দশমীর দিন মালা থেকে আপেলগুলি খুলে হরির লুটের মতো ছুঁড়ে দেওয়া হয়। বিশ্বাস করা হয়, যে যতগুলি ফল লুফতে পারবেন, তাঁর তত পাপক্ষয় হবে। কারণ মা ফলহারিণী। সপ্তমীতে মাকে পরানো হয় রজনীগন্ধার মালা। অষ্টমীতে গোলাপের মালায় সেজে ওঠেন মা। সন্ধিপুজার সময় জুঁই, বেলপাতা ও অপরাজিতার মালা পরেন মা। নবমীতে মাকে সাজানো হয় শিউলিফুলের মালায়। কোনো বছর এই সাজের অন্যথা হয় না। দশমীতে সমস্ত অলঙ্কার খুলিয়ে মাকে সাজানো হয় ফুলের সাজে। পরনের বেনারসীর উপরেই পরিয়ে দেওয়া হয় চওড়া লাল পাড়ের শাড়ি। কারণ একবার বরণের সময় প্রদীপ থেকে মায়ের শাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছিল। তারপর থেকেই শাড়ি বদলের এই রীতি চালু হয়েছে পরিবারে। পাশাপাশি প্রতি বছর উমার জন্য গয়নার বায়না দেওয়া হয় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের তরফে। সুদীপা জানিয়েছেন, এই বছর মায়ের জন্য বড় নথের বায়না দেওয়া হয়েছে। মায়ের গয়না নিজের হাতে তৈরি করেন স্বর্ণকার। এছাড়াও মায়ের নাকে রয়েছে বাংলাদেশের কমল হীরে। মায়ের উর্ধাঙ্গ জুড়ে থাকে রূপোর অহেন বর্ম। রণসাজে সজ্জিত দেবী দুর্গার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরানো হয় সীতাহার। তার সঙ্গে থাকে ভিক্টোরিয়ান আমলে তৈরি জড়োয়ার ময়ূরকন্ঠী হার। এর সঙ্গেই থাকে প্রতি বছর ভক্তদের উপহার দেওয়া অলঙ্কার। দেবীর বাহন সিংহর মাথায় থাকে সোনার মুকুট। তবে মায়ের হাতে কালসর্প, ঢাল থাকে না। পরিবর্তে শান্তির বার্তাবাহী রূপোর পদ্ম থাকে মায়ের হাতে।

সুদীপা জানালেন, পুজোর ক’টা দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মায়ের সেখানেই কিভাবে যে কেটে যায়, বোঝা যায় না। নিজেরা বেশি সাজগোজের সময় না পাওয়া গেলেও পুজোর সময় পরিবারের পুরুষদের ধুতি ও জোড় বাধ্যতামূলক। মেয়েরা অধিকাংশই বেছে নেন নরম শাড়ি, হালকা গয়না, নথ। কারণ রান্নাঘরে কাটে তাঁদের অধিকাংশ সময়। সুদীপা পারিবারিক দুর্গাপুজোকে ঘিরে কিছু অলৌকিক ঘটনারও সাক্ষী। তিনি জানিয়েছেন, একবার এক সাংবাদিক চিত্রগ্রাহককে নিয়ে তাঁদের বাড়ির পুজোয় এসেছিলেন। সাংবাদিক সুদীপার সঙ্গে কথা বলছিলেন। অপরদিকে চিত্রগ্রাহক আগেই জানিয়েছেন, দেব-দেবীতে বিশ্বাস নেই তাঁর। তিনি বসে রয়েছেন দালানে। হঠাৎই তিনি সুদীপাকে ডেকে জানালেন, মা দুর্গাকে তিনি নড়তে দেখেছেন।

সুদীপার নিজেরও বিশ্বাস, তাঁদের মায়ের মুখের আদলে প্রতিদিন কিছু না কিছু পরিবর্তন আসে। প্রমাণ হিসাবে ক্যামেরায় তিনি মায়ের ছবিও তুলে রেখেছেন। ক্যামেরাতেও স্পষ্ট হয়েছে সেই পরিবর্তন। তবে এক বছরের ঘটনা ভুলতে পারেন না সুদীপা। প্রতি বছর দশমীর দিন বরণের পরে মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে অগ্নিদেব করজোড়ে মাকে আগামী বছর আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় দিয়ে বলেন, “আবার এসো মা”। কিন্তু সেই বছর এই নিমন্ত্রণ জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। অদ্ভুত ভাবে কেউ কিছুতেই দেবীপ্রতিমা নাড়াতে পারছিলেন না। তখন অগ্নিদেব নিজের ভুল বুঝতে পেরে নতজানু হয়ে, করজোড়ে আগামী বছর আসার আমন্ত্রণ জানাতেই নড়ে উঠেছিল মায়ের কাঠামো। এই ঘটনা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন সবাই। ‘মা’ হলেও তিনি যে ঘরের মেয়ে উমা।

Related Articles