১৯৩৫ সালে বাংলার কৃষ্ণনগরে জন্ম সৌমিত্র চ্যাটার্জি। বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন। কোর্টের উকিল হলেও বাড়িতে ছিল নাটকের চর্চা। প্রতিদিনের ব্যস্ততায় নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলতো বাড়িতেই নাটক। বাবাকে নাটকের দলে অভিনয় করতে দেখে ছেলেরো অভিনয় করার শখ জাগে। ছোট থেকেই সেই পরিবেশে বড় হওয়া তাঁর। তখন থেকেই অভিনয়ের প্রেমে পড়ে যান সৌমিত্র। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বাংলায় বি.এ অর্নাস পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেছিলেন।
নিজের পড়াশোনা শেষ করলেন, নাটক করছিলেন। নাটক করতে করতে ভাবলেন এবার সেলুলয়েড জগতে প্রবেশ করবেন। নীলাচলে মহাপ্রভু ছবি দিয়ে প্রথমে বড় পর্দায় অভিষেক করার কথা ছিল। কিন্তু না বলেই বাদ পড়ে যান। একেবারে শেষ মুহূর্তে, সুযোগ পান অসীম কুমার। কিন্তু তখন অভিনেতা ভেঙে পড়েননি। এরপর ১৯৫৯ সাল থেকে রুপোলি পর্দাতে রাজ শুরু। প্রথমে অপরাজিততে বাদ পড়ে যান কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘোরে অপুর সংসার আর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন কালজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। তৈরি হল সত্যজিৎ আর অপুর জুটি। সত্যজিৎ পরিচালিত ৩৪টি ছবির ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যা বিরল প্রাপ্তি। দুজনের চাষ করা জমির মধ্যে দু’টি ছিল স্বল্পদৈর্ঘ্যের। সব কটি সিনেমা ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইটে সুপার হিট। তারপর সৌমিত্রের ঝুলিতে ২৫০ র বেশি সিনেমাতে অভিনয় করেছেন। নিজের অভিনয় দক্ষতায় হয়ে উঠলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সম্রাট।
আজও ফেলুদার কথা মনে পড়লে সবার আগে ভেসে ওঠে সৌমিত্র বাবুর মুখ। নিজের মগজাস্ত্রকে সঙ্গী করে একের পর এক প্রবলেম সলভ করেছিলেন তিনি। ছোটো থেকে বড়ো সবারই মনের কথা বুঝতেন তিনি। সোনার কেল্লা সিনেমাতে ফেলুদা কেমন হয় তা তিনিই বুঝিয়েছিলেন। বইয়ের চরিত্রকে ফুটিয়ে বাস্তবে রুপোলি পর্দাতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নিপূণভাবে। ফেলুদা দাদাগিরির মঞ্চে জানিয়েছিলেন ,‘ সত্যজিত বাবু যখন ১৯৬৯ সালে সন্দেশ পত্রিকাতে ফেলুদা লিখতে শুরু করেছিলেন আমিও অসংখ্য বাঙালি পাঠকের মতো মুগ্ধ হয়ে পড়তাম সেই গল্পগুলি। মনে মনে ভাবতাম কোনোদিন যদি এই গল্পের অনুকরণে যদি সিনেমা হয় আর আমি যদি সুযোগ পাই তাহলে কি কিভাবে ফুটিয়ে তুলবো তাই ভাবতাম। পরবর্তী কালে তাই হয়েছিল। এমনকি ফেলুদা আরো বলেন, তাঁর অনুকরণে ছবি এঁকেই নাকি সত্যজিত রায় তৈরী হয় সোনার কেল্লা। তারপর ১৯৭৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি। সেই সময়কার বক্স অফিসে ১৩ লক্ষ টাকা আয় করে সোনার কেল্লা আর ছোট বাচ্চাদের আক্ষেপ মুছে যায় সোনার কেল্লাকে সিনেমা হিসেবে পেয়ে। আর ফেলুদা হিসেবে সৌমিত্রকে গেঁথে নেন বাংলার মানুষ।
সোনার কেল্লার জনপ্রিয় আর হিট হওয়ার পর ৫ জানুয়ারি ১৯৭৯ মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিত-সৌমিত্র জুটির ফেলুদা সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ ছবি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’।উৎপল দত্ত তথা মগনলাল মেঘরাজের সঙ্গে এই ছবিতে ফেলুদার জাদু আজও ভুলতে পারেনি বাঙালি দর্শক। তারপর সত্যজিৎ রায় ছিলেননা ছিলেন সৌমিত্র। তাই তো তিনি সত্যজিতের পরবর্তী কাজ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ছবির পাশাপাশি টেলিভিশনেও ফেলুদার চরিত্রে দেখা মিলেছে সৌমিত্রর। ঘুরঘুটিয়ার নানান ঘটনা আর গোলোকধাম রহস্য নিয়ে দুটি টেলিফিল্মে অভিনয় করেছিলেন এই কিংবদন্তী অভিনেতা। যা ছবির পাশাপাশি টেলিভিশনেও ফেলুদার চরিত্রে দেখা মিলেছে সৌমিত্র। পরবর্তী কালে টেলিভিশনের পর্দাতে এসেছেন ফেলুদা যেমন সন্দীপ রায়ের ছবিতে ফেলুদা হিসাবে দর্শক দেখেছে সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং আবির চট্টোপাধ্যায়কে। কিছু দিন পর সৃজিতের ফেলুদা হিসাবে ওয়েব সিরিজে দর্শক দেখতে পাবেন টোটা রায়চৌধুরীকে। তবে কালজয়ী সৌমিত্র চ্যাটার্জিকে কেউ হারাতে পারবেননা। হরফ করে বলা যাবে সত্যজিতের ফেলুদা আর কোনোদিন কোনো ভারতবাসী দেখতে পাবেননা।