আর মাত্র কয়েক ঘন্টার প্রতীক্ষা। তারপরেই মুক্তি পেতে চলেছে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Paran Bandopadhyay) ও দেব (Dev) অভিনীত ফিল্ম ‘টনিক’। তবে এই ছবির নায়ক পরাণ। দেব অবাক হয়ে গিয়েছেন বর্ষীয়ান অভিনেতার রিভার রাফটিং, সাইকেল চালানো দেখে। পরাণ কিন্তু উচ্ছ্বসিত ‘টনিক’-এ অভিনয় করে। পরিচালক অভিজিৎ সেন (Abijit Sen) বুঝতে পারেননি, তাঁর হালকা ছলনাকে পরাণ এত সিরিয়াসলি নিয়ে নেবেন। দোটানায় ছিলেন দেব নিজেও। তিস্তার পাড়ে গিয়ে “পাঁচ মিনিট লাগবে” বললেও মনে মনে ভয় পেয়েছিলেন তিনিও। বোটে চড়ে পরাণ কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই দেখেন, আকাশচুম্বী ঢেউ আছড়ে পড়ছে। খুব রাগ হয়েছিল দেবের উপর। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, বাঃ, দিব্যি করে ফেললেন তো! ওদিকে দেব তো তখন হাত জোড় করছেন।
View this post on Instagram
তবে পরাণের মতে, দেব পুরোপুরি একজন টিম ম্যান। সবাইকে নিয়ে, সুন্দরভাবে চলার ক্ষমতা আছে তাঁর। পরাণ কখনও কখনও দেবকে অভিনয়ের টিপস দিয়েছেন। বলেছেন, সিরিয়াস দৃশ্যে অভিনয়ে জোর দিতে হবে, সংলাপে নয়। কারণ পরাণ মনে করেন, সংলাপ হল অক্ষম অভিনেতার আত্মরক্ষার বর্ম। পরাণের এখনও মনে আছে, একবার ‘মীরাক্কেল’-এর একটি বিশেষ পর্বে দেব এসেছিলেন অতিথি হয়ে। গল্প করতে করতে বলেছিলেন, তাঁর স্বপ্ন, বাবাকে একটি নতুন বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার। পরাণ নিজেও একজন পিতা। তাঁকে ছুঁয়ে গিয়েছিল দেবের কথাগুলি। আসলে, কথা নয়, সে যে ছিল দেবের স্বপ্ন। ‘টনিক’-এর একটি আবেগঘন দৃশ্যে দেবকে জড়িয়ে ধরে সংলাপ বলতে গিয়ে পরাণের মনে পড়ে গিয়েছিল সেই স্বপ্নের কথা। স্বপ্নটা এক লহমায় পরাণ ও দেবকে পিতা-পুত্র বানিয়ে দিল।
View this post on Instagram
তবে আশি বছর বয়সে রক ক্লাইম্বিং করতে গিয়ে পায়ে একটু ব্যথা পেয়েছিলেন পরাণ। তা দু-আড়াই মাস ভুগিয়েছিল বটে! কিন্তু থামেননি পরাণ। আকাশে ওড়ার সময় চোখ খোলেননি। কিন্তু শীতের রাতে বৃষ্টিতে ভেজা, বাথটাবে স্নান? পরাণের কাছে এগুলো জলভাত। কম বয়সে কি কম দুষ্টু ছিলেন নাকি! পাঠকরা নিশ্চয়ই মনে করবেন, শ্রদ্ধেয় লেখক মুন্সী প্রেমচন্দ (Munshi Premchand)-এর লেখা একটি কাহিনী, বঙ্গানুবাদে যার নাম দ্বিতীয় শৈশব। আশি বছর বয়সটাও দ্বিতীয় শৈশব বৈ কি!
View this post on Instagram
অপরদিকে মুম্বইয়েও পরাণ শুরু করে দিয়েছেন নতুন ইনিংস। ‘বব বিশ্বাস’-এ কালীদার চরিত্রে অভিনয় করে নজর কাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নামী হাউসের কাস্টিং ডিরেক্টরের ফোন। তিনি আবার গড়গড় করে হিন্দিতে পুরো গল্প বলে গেলেন। এরপর জানা গেল, গোয়া, আন্দামানের মতো জায়গায় হবে শুটিং। পরাণের পক্ষে বর্তমানে সম্ভব নয় বাংলা ছেড়ে গোয়া, আন্দামান দৌড়ানো। তাছাড়া মুম্বইয়ের ডাক আগেও এসেছে। কিন্তু পরাণ মনে করেন, বলিউড বড্ড মেকানিক্যাল। সৃষ্টি ওভাবে হয় না। বাংলার সম্পদ উপেক্ষা করে মুম্বই যাওয়ার পক্ষপাতী নন তিনি।
View this post on Instagram
পরাণ ওটিটি দেখেন না। রিমোট টিপে হাত ব্যথা করে নান্দনিক হতে চান না তিনি। বাংলা সিরিয়ালও নৈব নৈব চ! সেখানে তো সারাদিন শাড়ি-গয়না, বৌদের কান্নাকাটি, বিয়ে আর পুজো-আচ্চা। মুখে না বললেও সকলের মতোই তাঁরও বিরক্ত লাগে। চোখ খোঁজে ভালো কাহিনী। অনেকে মনে করেন, পরাণ কমেডিয়ান। কিন্তু তাঁর মতে, কমেডিয়ান একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। রবি ঘোষ (Rabi Ghosh), ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (Bhanu Banerjee), চার্লি চ্যাপলিন (Charlie Chaplin) কমেডিয়ান হলেও কখনও কখনও চোখে জল চলে আসে। প্রকৃতপক্ষে, শেক্সপীয়রিয়ান ধারা অনুসারে, কমেডি, ট্র্যাজেডি, দুটি ধারার মূলে রয়েছে অসঙ্গতি। পরাণেরও একই মত। অভিনয় জীবনের পাশাপাশি একসময় সরকারি চাকরি করতেন পরাণ। সেই সময়ের একটি ঘটনা তাঁর এখনও মনে আছে। উৎপল দত্ত (Utpal Dutta)-এর পরিচালনায় ‘চৈতালি রাতের স্বপ্ন’ করার সময় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোলার ম্যানারিজম করবেন কিনা! উৎপল বলেছিলেন, ভালো লাগলে গ্রাহ্য, নাহলে অগ্রাহ্য। রবীন্দ্র সদনে রিহার্সালের সময় পরাণের তোতলামি দেখে তিনি হেসে ফেলেছিলেন। পরাণ বুঝেছিলেন, তাঁর ভালো লেগেছে।
পরে ডেকেছিলে উৎপল। দুরুদুরু বুকে হাজির পরাণ। উৎপল জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পরাণ কি মাস্টারি করেন! পরাণের উত্তর, “না, সরকারি চাকরি করি”। উৎপল তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পরাণ তোতলাদের মাস্টারি করেন কিনা! এর অর্থ দশে সাড়ে আট। পাঠকবর্গ প্রশ্ন করতেই পারেন, বাকি দেড় নম্বর! ওটা শিল্পীর অধরাই থাকে। কারণ সেই দেড় নম্বর তাঁকে তাঁর অজান্তেই করে তোলে ‘পারফেকশনিস্ট’।
তবে ‘টনিক’ নিয়েই ক্ষান্ত নন পরাণ। ইতিমধ্যেই শেষ করেছেন অনীক দত্ত (Anik Dutta) পরিচালিত ফিল্ম ‘অপরাজিত’-র কাজ। শ্রীজাত (Srijato)-র অতি বিতর্কিত ‘মানবজমিন’ -এর কাজ রয়েছে সামনে। শিবপ্রসাদ (Shibaprashad) ও নন্দিতা (Nandita)-র তরফে ‘হামি টু’-র প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু অনেক দূরে যেতে হবে বলে পরাণ অভিনয় করতে চাননি। ইদানিং চোখের কারণে বেশি পড়াশোনা না করতে পারলেও একটি নতুন নাটক লিখছেন। তবে আশি বছর বয়সে এসে পরাণ বুঝতে পারেন, তাঁর প্রতিভাকে দাম দেওয়ার থেকেও বেশি অনেকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আসেন। কিন্তু তাঁকে ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজ নয়। কারণ তিনি ‘এভারগ্রিন’ পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজেই বলেছিলেন, বাংলায় অনেক সম্পদ আছে। কিন্তু পরাণ যে নিজেই বাংলার ‘কোহিনূর’ যাঁর আলোয় আলোকিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।
View this post on Instagram