উত্তম কুমার (Uttam Kumar) বাঙালির একান্ত আপন। তাঁর অভিনয়শৈলীর পাশে এত বছর পরেও দাঁড়াতে পারেন না কোনো নায়ক। তিনি অতুলনীয়, অচেনা নয়, বাঙালির বড্ড চেনা। কিন্তু সমগ্র ভারতে রাজত্ব করতে পারতেন উত্তম। তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে অচিরেই হয়ে উঠতে পারতেন ভারতের মহানায়ক। রাজেশ খান্না (Rajesh Khanna) পেয়েছিলেন এশিয়ার প্রথম সুপারস্টারের তকমা। কিন্তু এই তকমা কি উত্তমের হতে পারত না? বলিউডে তাঁকে বেশ কয়েকটি ফিল্মে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। উত্তম ক্ষমতা রাখতেন তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে অবাঙালিদের মন জয় করার।
View this post on Instagram
সুপ্রিয়া দেবী (Supriya Devi)-কে বিয়ে করে তখন রীতিমত সংসার করছেন উত্তম। একের পর এক বাংলা ফিল্মের প্রজেক্ট তাঁর হাতে। এই সময় একদিন রাজ কাপুর (Raj Kapoor)-এর তরফে এল ‘সঙ্গম’ ফিল্মে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব। বর্তমান কালে দেখা যায়, নায়করা প্রযোজক হয়ে তাঁরা নিজেদের ফিল্মের মূল চরিত্র হিসাবে নির্বাচন করছেন। কিন্তু রাজের ব্যক্তিগত জীবন যতটা রঙিন ছিল, তার থেকে অনেক কঠোর ছিল তাঁর পেশাদারিত্ব। রাজ কাজের সাথে আপোষ পছন্দ করতেন না। এই কারণে একাধিক ফিল্মে তিনি শুধুই ক্যামেরার পিছনে থেকেছেন। নায়ক নির্বাচিত করেছেন অপর কোনো অভিনেতাকে। তাঁর এই ক্ষমতাই রাজকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ‘শোম্যান’ হিসাবে।
View this post on Instagram
রাজ, উত্তমকে ভেবেছিলেন ‘সঙ্গম’-এর নায়ক হিসাবে। অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন সুপ্রিয়া। ভেবেছিলেন, উত্তম বম্বের মাটিতে মর্যাদা সহকারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু অবলীলায় উত্তম ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ‘সঙ্গম’-এর প্রস্তাব। অনেক অজুহাত ছিল উত্তমের। ‘সঙ্গম’-এ দ্বিতীয় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে চাননি তিনি। কিন্তু উত্তমের মৃত্যুর বহুদিন পর জীবদ্দশায় সুপ্রিয়া খোলসা করেছিলেন প্রকৃত কারণ। তিনি বলেছিলেন, সেই সময় উত্তমের চারপাশে জুটে গিয়েছিল স্তাবকের দল। সুপ্রিয়া নয়, তাদের পরামর্শ মেনে চলতে শুরু করেছিলেন উত্তম। তিনি ভেবেছিলেন, ওই স্তাবকরা তাঁর শুভাকাঙ্খী। ফলে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রাজকে। ইতিহাস তৈরি করেছিল ‘সঙ্গম’। নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সেই ইতিহাসের শরিক হতে পারলেন না মহানায়ক। তাঁর পরিবর্তে ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজেন্দ্র কুমার (Rajendra Kumar)।
View this post on Instagram
তবে রাজ ছিলেন জহুরী। তিনি রত্ন চিনতে জানতেন। ফলে আবারও রাজ এসেছিলেন উত্তমের দরজায়। এবার তাঁর কাছে ছিল বাংলা ফিল্ম ‘একদিন রাত্রে’-র প্রস্তাব। এটি ছিল হিন্দি ফিল্ম ‘জাগতে রহো’-র বাংলা রিমেক। কিন্তু উত্তম পারলেন না ডেট দিতে। আসলে তিনি ডেট দিতেই চাননি। কারণ উত্তমের স্টারডমের সাথে তৈরি হয়েছিল তাঁর ইগো। রাজকে নিজের প্রযোজক হিসাবে দেখতে আপত্তি ছিল তাঁর। ভুল যখন বুঝেছিলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
1967 সালে উত্তম বলিউডে প্রযোজনা করেন ‘ছোটি সি মুলাকাত’। এই ফিল্মে উত্তম ছিলেন নায়ক। তাঁর বিপরীতে ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা (Vaijayantimala)। প্রযোজক হিসাবে এই ফিল্মের জন্য কোনো দায়িত্ব পালন করেননি উত্তম। চূড়ান্ত অসফল হয়েছিল ‘ছোটি সি মুলাকাত’। সেই সময় বলিউডের নায়কদের প্রত্যেকের মধ্যেই ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্য। উত্তম চাইলে নিজের বৈশিষ্ট্য অবলীলায় তৈরি করতে পারলেন। কিন্তু তিনি হিন্দি শিখতেও অনীহা বোধ করছিলেন। পরবর্তীকালে গুলজার (Gulzar) আক্ষেপ করেছেন, সঠিক হিন্দি বলতে পারলে উত্তম হয়ে উঠতেন ন্যাশনাল স্টার। ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ফিল্মে উত্তমের হিন্দি ডিকশন রীতিমত সমালোচিত হয়েছিল।
View this post on Instagram
এই সেই উত্তমকুমার যিনি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কঠিন লড়াইয়ের মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন নিজের স্থান। একের পর এক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রত্যেকটি চরিত্র একে অপরের থেকে আলাদা। তবু স্টারডম ও ইগো শেষ করে দিয়েছিল উত্তমের ইচ্ছাশক্তিকে। বম্বে জয় অধরাই রয়ে গেল। জীবন সায়াহ্নে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন উত্তম। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র শুটিং করতে গিয়ে হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন বেশিদিন আর মেয়াদ নেই। নিখুঁত ভাবে শেষ করতে চেয়েছিলেন ফিল্মটি। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সেটেই প্রয়াত হলেন সর্বকালের সেরা অভিনেতা। নশ্বর দেহ রইল না। কিন্তু বাঙালির মনে রয়ে গেল চিরকালের আফশোস, উত্তম কুমার তো জাতীয় তারকা হতেই পারতেন।
View this post on Instagram