‘গোয়াবাগানের গৌরাঙ্গ এখন গেরুয়া’, এক সংবাদ মাধ্যমের সাক্ষাৎকারে মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun chakraborty)-কে এই প্রশ্নই করা হয়। ‘মহাগুরু’ অবশ্য এই কথা শুনে হেসে ফেললেও তিনিও হয়তো জানেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বাঙালি জাতির একাংশ এই মুহূর্তে অসন্তুষ্ট।
মিঠুন চক্রবর্তী কি সত্যিই রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিলেন? তাহলে পিছিয়ে যাওয়া যাক সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনে উত্তাল কলকাতায়। তখন মিঠুন ওরফে গৌরাঙ্গ স্কটিশচার্চ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়েছেন। কলকাতার সব কলেজেই তখন চোরাগোপ্তা নকশাল আন্দোলনের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে ভেসে গেলেন গৌরাঙ্গও। গৌরাঙ্গর জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই নকশাল আমল। নকশাল আন্দোলনে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সখ্যতা ছিল অন্যতম নকশাল নেতা রবি রঞ্জন (Ravi Ranjan)-এর। রবি রঞ্জন সবার কাছে ‘ভা’ বা রক্ষাকর্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। নকশাল আন্দোলনের কারণে একসময় গৌরাঙ্গকে গা ঢাকাও দিতে হয়েছিল। সেই সময় তাঁকে শেষবারের মত যে মানুষটি দেখেছিলেন, তিনি হলেন স্কটিশচার্চ কলেজের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার সমর কুমার মল্লিক (samar kumar mullick)। কিন্তু বিধাতার লিখন ছিল অন্য। গৌরাঙ্গ যখন নকশাল আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত তখন তাঁর একমাত্র ভাই বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যান। স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়েছিলেন গৌরাঙ্গ ওরফে মিঠুনের মা-বাবা। চিরকাল মিঠুন চক্রবর্তীর কাছে তাঁর পরিবার সর্বাগ্রে। তিনি মা-বাবার কাছে ফিরে এলেন। পিছনে পড়ে রইল উত্তাল নকশাল সময়।
এরপর ধীরে ধীরে গৌরাঙ্গ যাত্রা করেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী হওয়ার পথে। মৃণাল সেন (Mrinal sen) পরিচালিত ‘মৃগয়া’-য় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরেও মুম্বইতে তাঁর বহু রাত কেটেছিল প্রযোজকের অফিসের বেঞ্চে শুয়ে। কিন্তু তবু তিনি সেদিন রাজনীতিবিদ হওয়ার কথা ভাবেননি। বলিউডের একটি বড় অংশকে মিথ্যা প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের স্টারডম। যোগিতা বালি (yogita bali)-কে বিয়ে করার পরেও 1985 সালে শ্রীদেবী (sridevi)-কে বিয়ে করেছিলেন মিঠুন। 1988 সালে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
স্টারডম, পরিবার, ভালোবাসা, সারমেয়-প্রীতি নিয়ে বেঁচে থাকা মিঠুন রাজনীতি থেকে শত হস্ত দূরে ছিলেন। একসময় বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসাবে মিঠুনকে ভোটে দাঁড় করানোর প্রস্তাব দিয়েছিল সিপিএম। বিপক্ষে প্রার্থী ছিলেন অজিত পাঁজা (Ajit panja)। কিন্তু মিঠুন এই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন কারণ অজিত পাঁজা ছিলেন তাঁর অত্যন্ত পছন্দের মানুষ। মিঠুনের এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, তিনি বারবার সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়েছেন। মিঠুন ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে বহু মানুষের উপকার করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)-এর অনুরোধে রাজ্য সভার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন মিঠুন। কিন্তু সেখানেও ছিল একটি শর্ত, রাজনীতি করবেন না তিনি। শুধুই করবেন মানুষের সেবা। রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তৃণমূল হাইকম্যান্ড। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নির্মল ভাই-বোনের সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল মিঠুনের। সেদিন তিনি বলেছিলেন, কখনও যদি রাজনৈতিক কারণে ভাই-বোনের সম্পর্কে আঁচ আসে, তৎক্ষণাৎ তিনি পদত্যাগ করবেন। মমতা বলেছিলেন, মিঠুন তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন না। মিঠুনের মনে হয়েছিল, মমতা মনে আঘাত পেয়ে এই কথা বলেছেন। তখন মিঠুন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পদত্যাগ করার। অর্থাৎ এখানেও কিন্তু সম্পর্ককে বাঁচাতেই রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন মিঠুন। তাহলে হঠাৎই বিজেপিতে যোগদান কেন করলেন মিঠুন?
প্রকৃতপক্ষে, বাংলার ‘ভূমিপুত্র’ মিঠুন বারবার চেয়েছেন বাংলার জন্য কাজ করতে। অনেকেই জানেন না 2020 সালের লকডাউনের সময় করোনায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন মিঠুন। কিন্তু বাংলা তথা ভারতে যে কোনো ভালো কাজ করতে গেলেই রাজনীতি কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে নিজের জায়গা করে নেয়। মিঠুন বাংলার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে যতবার কাজ করতে চেয়েছেন তীব্র রাজনৈতিক বাধা পেয়েছেন। এই কারণে গেরুয়া শিবিরে যোগদান করেছেন ‘মহাগুরু’। কিন্তু মিঠুন কি সত্যিই তাঁর মানবসেবার আদর্শ নিয়ে টিকতে পারবেন বিজেপিতে? এর উত্তর দেবে সময়।