বাংলার মহানায়িকা মানেই যার নাম আসে তিনি হলেন সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম কিংবদন্তি। যাঁর জায়গায় আজও টলিউডের কোনো অভিনেত্রী তার ধারে কাছেও যেতে পারেননি। ষাটের দশকের সেই মায়াভরা আর গ্ল্যামার চোখ আর লাস্যময়ীর অভিনয়ে আজও ডুবে রয়েছে বহু ভক্ত। মহানায়িকাকে নিয়ে আজও বাঙালির মন সেই উড়ুউড়ু। তাঁর বাকা ঠোঁটের হাসি দেখলে আজও যেন হৃদপন্দনটা একটু হলেও বেড়ে যায়। বছর আসবে, বছর যাবে বহু নায়িকা আসবে কিন্তু মহানায়িকা সুচিত্রা সেন থেকে যাবে বাঙালির মনের ঠিক ডান পাশে। বাঙালির হৃদয় জুড়ে থাকবেন শুধুই সুচিত্রা।
কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী রমা সেন। রমা প্রথমে একদিন স্বামীর সাথে দিতে গিলেন সিনেমার ইন্টারভিউ দিতে। কিন্তু প্রথমে শব্দ উচ্চারণে এল নানা বিপত্তি। প্রথমেই পড়ে যাচ্ছিলেন বাদ। তারপর নিজের জেদে বাংলা চলিত ভাষা শিখে পরের দিন গেলেন স্টুডিওতে। তারপরই রমা সেন ১৯৫১ সালে পরিচালক সুকুমার রায়ের সাথে প্রথম কাজ ‘১৯৫১ সালে সাত নম্বর কয়েদী’ সিনেমায় আত্মপ্রকাশ। তারপর ১৯৫২ সালে স্বামীর সাথে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে আসেন। তারপরই টলিপাড়ার রুপোলী পর্দায় ‘শেষ কথায়’ সিনেমাতে নায়িকা রুপে ডেবিউ করলেন পাবনার রমা সেন। কিন্তু এই সিনেমা কখনোই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি। কিন্তু সিনেমায় নামার পর নাম পাল্টে হলেন আজকের কালজৈয়ী অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন।
ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বাঙালির স্বপ্নপূরণের নায়িকা। ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম কুমারের বিপরীতে প্রথম অভিনয় করেন। এ সিনেমার মধ্য দিয়ে নজর কাড়েন অভিনেত্রী। তারপর এই জুটি হয়ে যান বাংলা সিনেমার সেরা জুটি। উত্তম-সুচিত্রা ছিলো তখনকার চলচ্চিত্র জগতের আশীর্বাদ। কখনো প্রেম যুগল, কখনো দাম্পত্যজীবনের গল্পে তারা হয়ে উঠেছিলেন অনবদ্য। তারপর ঠিক এক বছর পর ১৯৫৪ সালে পর পর ৯টা ছবিতে সই করলেন সুচিত্রা সেন। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি অভিনেত্রীকে। ১৯৫৩- ১৯৭৮ পর্যন্ত নিজের রুপের জালে আর অভিনয় দক্ষতায় একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিলেন বাঙালী দর্শকদের।
ছয়ের দশকের সাহসিনী এই নারী যেভাবে প্রচলিত ট্যাবু ভেঙে গৃহবধুর ইমেজ ভেঙে নিজেকে মহানায়িকা হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন তা আজও অক্ষত রয়েছে সকলের হৃদয়ে। আর এই কারণেই তিনি উত্তম কুমারের নন, সকলের প্রিয় ‘মহানায়িকা’। কিন্তু মহানায়িকা নিজে শাড়ি পড়ে নিজেকে সেই সময়ে থেকে থাকেননি। ফ্যাশন স্টেটমেন্টেও তখনকার সময়ে তিনি সেরা আইকন ছিলেন। তখন সোশ্যাল মিডিয়া আর মোবাইলের যুগ না থাকলেও তার লাস্যময়ী ভঙ্গির শরীরী উন্মাদনা ছবি তুলে বিভিন্ন পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের ফটোশুট সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
সুচিত্রা দেবী সবধরনের পোশাকেই সাবলীল ছিলেন। কখনো ইন্দো ওয়েস্টার্ন তো সাবেকিয়ানা সাজে সবেতেই বাজিমাত করেছেন। কখনও মাথায় বড় হ্যাট পরেছেন তো কখন চোখে গগলস-কোনওকিছুই যেন এই অভিনেত্রীকে থামাতে পারেনি। সেই যুগে কোনো বাঙালি অভিনেত্রী সুইম স্যুট পড়ে ছবি দেওয়ার সাহস করেননি। কিন্তু সুচিত্রা স্যুইম স্যুট পড়ে সাহসীকতার সঙ্গে সেটাকে উপস্থাপনও করেছেন। সেই যুগে কখনও ট্রোলের শিকার হননি অভিনেত্রী।
কিন্তু এই নায়িকা একদিন নিজেই নিজের অন্তর্ধানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আসল কারণ হল, শেষ সিনেমা ‘প্রনয় পাশা’ ফ্লপ হল। তিনি তখনই বুঝলেন তাঁর দিন শেষ সেই টের পেয়েছিলেন নিজের খারাপ সময়ের। আর তারপরই কোনো চলচ্চিত্রে কাজ করেননি। কোনোদিন আর জনসমক্ষেও আসেননি। চলে গিয়েছিলেন চির অন্তরালে। অনেকে অনেক চেষ্টা করেও তাঁর কোনও ছবি তুলতে পারেনি। শুধুমাত্র একবার ক্যামেরার সামনে এসেছিলেন নিজের ভোটার কার্ডের ছবি তুলতে নিজের মেয়ে আর নাতনির সাথে। কিন্তু এই ছবি কখনোই প্রকাশ্যে আসেনি। অভিনয় না করলেও আড়ালে থেকে রামকৃষ্ণের সেবায় ব্রতী হন।
২০০৫ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নেওয়ার ছিল শর্ত। কিন্তু কোনো জনসমক্ষে না আসার জন্য দিল্লি যাওয়ায় আপত্তি থাকার কারণে তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা সেনের নিজের অন্তর্ধান জীবন শেষ করলেন।