whatsapp channel
BollywoodHoop PlusHoop Special

Meena Kumari: মৃত্যুকে ভালোবেসেছিলেন মীনা কুমারী

মুম্বইয়ের ভরা বর্ষা এখনও সযত্নে ধুয়ে দেয় রহমতাবাদ গোরস্থানের শ্বেতপাথরের ফলকটিকে। মায়ানগরী চলে তার নিজস্ব ছন্দে। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা প্রায় ভুলতে বসেছে বলিউড। কিন্তু ভুলতে চেষ্টা করলেও তা ভোলা যায় না। এতটা ট্র্যাজিক কেন হল ট্র্যাজেডি কুইনের জীবনের শেষ মুহূর্ত? কেন আজও মীনা কুমারী (Meena Kumari)-র মৃত্যু রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা?

জীবিত থাকলে আজ বয়স হত ৮৮ বছর। হয়তো বা ওয়াহিদা রহমান (Wahida Rehman)-দের সাথে যেতেন ছুটি কাটাতে। নিজের মতো করে লিখতেন উর্দু শায়েরি। বহু সম্ভাবনা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। জীবন সত্যিই কি বাঁচতে শিখিয়েছিল মীনা কুমারীকে? নাকি তিনি মরে বেঁচে ছিলেন? ঝকঝকে স্টারডমের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিল মেহেজবিন বানু (Mahajbeen Banu)। সুন্নি মুসলমান পরিবারের মেয়ে মেহেজবিনের বাবা আলি বক্স (Ali Bux) পাকিস্তান থেকে বম্বে এসে যোগদান করেছিলেন পার্শি থিয়েটারে। তাঁর প্রথম স্ত্রী প্রয়াত হয়েছিলেন নাকি তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তা জানা যায় না। কিন্তু আলি বক্সের প্রেমে পড়েছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রভাবতী দেবী (Prabhabati Devi)। প্রভাবতীর মা হেমসুন্দরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)-এর তুতো বোন। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে হেমসুন্দরী একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে মেরঠ। মেরঠে নার্সের কাজ করতেন হেমসুন্দরী। খ্রীষ্টান হয়ে বিয়ে করেছিলেন সাংবাদিক পেয়ারে লাল শাকির মীরাঠী (Pyare lal Shakir Meeruti)-কে। শৈশব থেকে বড্ড বেশি সাহসী প্রভাবতী ভালোবেসে বিয়ে করলেন তাঁর থেকে বয়সে অনেকটাই বড় আলি বক্সকে। মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে নাম নিলেন ইকবাল বেগম (Iqbal Begum)।

 

View this post on Instagram

 

A post shared by Cinemaazi (@cinemaazi)

গোঁড়া সুন্নী মুসলমান আলি চাইতেন পুত্রসন্তান। কিন্তু প্রথমবার কন্যাসন্তান হল। নাম রাখা হল খুরশিদ (Khursheed)। আলি কিছুই বললেন না। দ্বিতীয়বার ইকবাল বেগম গর্ভবতী হলে আলির ধারণা ছিল, এবার পুত্রসন্তান আসবে তাঁর বংশরক্ষা করতে। কিন্তু তাঁর আশায় জল ঢেলে জন্ম হল মেহেজবিনের। তৃতীয়বার চেষ্টা করেছিলেন আলি ও ইকবাল। জন্ম হয়েছিল মাহলিকা (Mahlika)-র। কিন্তু আলির সব রাগ গিয়ে পড়েছিল মেহেজবিনের উপর। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা হতে রাজি ছিলেন না আলি। জন্মের পরেই মেহেজবিনকে অনাথ আশ্রমের দরজায় ছেড়ে এসেছিলেন আলি। কিন্তু হঠাৎই কি মনে হওয়ায় কিছুক্ষণ পর নিজেই গিয়ে শিশুকন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। মাত্র চার বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল মেহেজবিনকে। আলি ও ইকবাল দুজনেই বুঝতে পেরেছিলেন, কালে কালে রূপসী হবে এই মেয়ে। জন্ম নিয়েছিল লোভ। তাঁরা দুজনে কন্যাসন্তানকে অর্থ রোজগারের উপায় হিসাবে ব্যবহার করলেন। স্কুল ছাড়িয়ে দেওয়া হল। জোর করে, ধাক্কা মেরে চার বছর বয়সের শিশুকে পাঠানো হল সিনেমায় অভিনয় করতে। মেহেজবিন কাঁদতে চেয়েছিল, পারেনি। এভাবেই তার উপর চোখ পড়ল বিজয় ভাট (Vijay Bhatt)-এর। ছোট্ট মেহেজবিনকে তিনিই প্রথম সুযোগ দিলেন ‘লেদারফেস’ ফিল্মে। 1939 সালে মুক্তি পেল ‘লেদারফেস’। এরপর থেকেই শুরু হল পরিবারের ঘানি টানা। ইকবাল বেগম ও আলির অর্থ উপার্জনের চেষ্টা ছিল না। মেহেজবিনকেই চার বছর বয়স থেকে সংসার চালানোর ভার নিতে হয়েছিল। তার মা-বাবার কাছে সে ছিল সোনার ডিম পাড়া হাঁস। একের পর এক ফিল্ম। ক্লান্ত মেহেজবিন কাজ করে চলছিল। 1940 সালে বিজয়, মেহেজবিনকে দিলেন নতুন পরিচয় ‘বেবি মীনা’। ‘এক হি ভুল’ ফিল্মের টাইটেল কার্ডে প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছিল এই নাম। হারিয়ে গেল শৈশব, হারিয়ে গেল মেহেজবিন।

ধীর পায়ে এল 1946 সাল। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে মুক্তি পেল ‘বাচ্চোঁ কা খেল’। আত্মপ্রকাশ করলেন সুন্দরী নায়িকা মীনাকুমারী। একের পর এক ফিল্মে অভিনয় করলেও 1952 সালে নির্মিত ফিল্ম ‘বৈজু বাওরা’ মীনাকে করে তুলল তারকা। এরপর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি মীনাকে। তারকা হয়ে ওঠার পথে কয়েকটি ফিল্মে দুর্ধর্ষ অভিনয় করে চোখে জল এনে দিয়েছিলেন মীনা। দর্শকদের একাংশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘ট্র্যাজেডি কুইন’। ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন ইকবাল। দর্শকরা বোধহয় জানতেন না, তাঁদের প্রিয় নায়িকা সত্যিই ‘ট্র্যাজেডি কুইন’।

‘পাকিজা’ সেই সময় প্রস্তাবিত। মীনা একটু বিশ্রাম চেয়েছিলেন। বিয়ে করে সংসার করতে চেয়েছিলেন। ততদিনে তাঁর সাথে আলাপ হয়েছে কামাল আমরোহী (Kamal Amrohi)-র। বয়সে বড় ও বিবাহিত কামালকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন মীনা। 1952 সালের 14 ই ফেব্রুয়ারি কামালকে বিয়ে করেন মীনা। সেই সময় মীনার বিয়ের খবরটি গোপন থাকলেও পরবর্তীকালে আলি তা জানতে পেরে মীনাকে বিবাহ বিচ্ছেদের নির্দেশ দেন। জীবনে প্রথমবার বাবার নির্দেশ মানেননি মীনা। তবে বাবার বাড়ি ছেড়েও আসেননি তিনি। কিন্তু আলি চাইছিলেন না মেয়ের সংসার। তাঁর ভয় ছিল, বন্ধ হয়ে যাবে অর্থ আসা। ফলে বাড়ি ছাড়লেন মীনা এবং কামালের সাথে থাকতে শুরু করলেন। কামালের প্রথম পক্ষের সন্তানরা পছন্দ করতেন মীনাকে। তাঁরা মায়ের মতোই ভালোবাসতেন তাঁকে। মীনাও তাঁদের নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। কিন্তু মীনা যে ‘ট্র্যাজিক কুইন’। অতএব ঘটল ছন্দপতন।

কামালের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মীনা। সেদিন তিনি সেপারেশনের বিষয়ে একটি কথা বলেননি। তবে পরে জানা যায়, প্রথমদিকে মীনার কেরিয়ারকে সমর্থন করলেও পরবর্তীকালে স্ত্রীকে অভিনয় করতে দিতে রাজি ছিলেন না কামাল। এমনকি শারীরিক নির্যাতন করেছিলেন মীনাকে। স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে মীনা চলে যান তাঁর বোন মাহলিকার বাড়ি। অপরদিকে ক্রনিক ইনসমনিয়া মীনাকে অ্যালকোহলিক করে তুলেছিল। চিকিৎসকের পরামর্শে ছোট এক পেগ ব্র্যান্ডি পান করতেন মীনা। ফলে তাঁকে স্লিপিং পিল খেতে হত না। কিন্তু 1964 সালে কামালের সাথে বিচ্ছেদের পর অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মীনা। 1968 সালে তাঁর লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে আবারও অভিনয়ে ফিরেছিলেন মীনা। সেই সময় জীবনে প্রথমবার বান্দ্রার কার্টার রোডে নিজের নামে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তিনি। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, বোনের বাড়ি ঘুরে রিফিউজি দশা নিজেই শেষ করেছিলেন তিনি। এতদিনে তাঁর নিজের বাড়ি হয়েছিল যেখান থেকে তাঁকে বের করার অধিকার ছিল না কারোর। কিন্তু শারীরিক ভাবে বড্ড দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন মীনা। শৈশব থেকে পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন, প্রথম জীবনে বাবার অত্যাচার ও পরে স্বামীর অত্যাচার ক্রমশ মানসিক অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছিল তাঁকে। এদিকে ইতিহাস তৈরি করল ‘পাকিজা’। মীনা বোধহয় এই সময়টুকুর জন্য বেঁচেছিলেন। সেই সময় কামাল আবারও ফিরে এসেছিলেন তাঁর কাছে।

1972 সালের 28 শে মার্চ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সেন্ট এলিজাবেথ নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল মীনাকে। কোমায় চলে গিয়েছিলেন। লিভার সিরোসিস আবারও ফিরে এসেছিল। নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে মীনা তাঁর স্বামী কামালকে বলেছিলেন, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। তাঁর গোর কোথায় দেওয়া হবে ও ফলকে কি লেখা থাকবে, তা সবই কামালকে বলেছিলেন তিনি।

31 শে মার্চ চলে গেলেন মীনা। নার্গিস লিখলেন “মওত মুবারক হো”। মীনাকে সমাধিস্থ করা হল। ফলকে লেখা হল, জীবনে অনেক ভাঙন, তবু তাঁর মনে কোনো আফশোস নিয়ে চলে যাননি তিনি। পুরোদস্তুর অভিনেত্রী ছিলেন মীনা। মৃত্যুর পরেও রক্ষা করেছিলেন মেহেজবিনের অশ্রুবিন্দু। পুরুষতন্ত্রকে হারিয়ে দিয়েছিলেন সমাধির ফলকের কয়েকটা শব্দের মধ্য দিয়ে। তাঁকে বারবার ভাঙার চেষ্টা করেছেন পুরুষরা। কিন্তু তিনি ভাঙেননি। ফলে কোনো আফলোস না করেই চলে গেলেন মীনা। বারবার হেরে যেতে যেতে মৃত্যুর শীতল আলিঙ্গনে জয় খুঁজে নিয়েছিলেন ট্র্যাজেডি কুইন।

whatsapp logo