বাংলা সিনেমার একজন অন্যতম আইকন মহানায়ক উত্তম কুমার। শুরুতে অরুণ কুমার নামে কিছু বানিজ্যিক ভাবে অসফল সিনেমা দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করেন, পরবর্তীতে নিজেই নিজের নামকরণ করেন। নির্মল দের পরিচালনায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি দিয়ে মহানায়কের নতুন পথের যাত্রা শুরু, এরপর তাঁকে আর পিছন ফিরে দেখতে হয়নি। আজও অনেক মানুষ কোন ঠাঁটবাট দেখা বাঙালীবাবু দেখলেই বলেন ‘নিজেকে কী উত্তম কুমার মনে হয়?’
পঞ্চাশের দশকে উত্তম কুমারের কিছু সিনেমা হিট না করলেও পঞ্চাশের শেষ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’ আর ‘সাগরিকা’-এর মতো কালজয়ী সিনেমা বাংলার দর্শকদের উপহার দিয়ে গেছেন। সেইসময় সুচিত্রা হোক বা সুপ্রিয়া দেবী বা সাবিত্রী সকলের সঙ্গে সমান রোম্যান্টিসিজিমে অভিনয় করে গেছেন। এখনো উত্তম কুমারের লিপে যেই গানগুলি হয় মনে হয় তিনিই স্বয়ং গাইছেন। এতটাই নিখুঁত ছিল তাঁর অভিনয় দক্ষত। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ ছিল উত্তম কুমারের সমস্ত সিনেমার মধ্যে সেরা সংযোজন।
নিজ ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগণে ঠিক তখনই তিনি ঠিক করলেন বলিউডে আসর জমাবেন। শুরু করলেন ‘ছোটি সি মুলাকাত’। এই হিন্দি সিনেমায় উত্তম কুমার নিজেই প্রযোজনা করেছিলেন। উত্তমের বিপরীতে ছিলেন তখনকার সময়ের দক্ষ ও সুন্দরী অভিনেত্রী বৈজয়ন্তীমালা। কিন্তু ভাগ্যের ফের ওই মুভি নিয়ে উত্তম কুমার মুখ থুবড়ে পড়েন। কিন্তু ঠিক কোন কারণে বাংলার রাজা আরব সাগরের তীরে গিয়ে তরী ডোবালেন?
এই ব্যপারে ভিন্ন জনের ভিন্ন মত রয়েছে। অনেকের ধারণা বৈজয়ন্তীমালা সে সময় উত্তম কুমারকে সঠিক ভাবে সাহায্য করেননি অভিনেত্রী হিসেবে। ‘দেবদাস’ মুভি নিয়ে কোন এক সময় উত্তম কুমারের সঙ্গে ঠাণ্ডা লড়াই চলেছিল বৈজয়ন্তীমালার। তবে একটা বিশেষ কারণ হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে উত্তমের ‘না’ বলা। কারণ উত্তম কুমারকে হিন্দি ছবিতে অভিনয় করার জন্য প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন হেমন্ত নিজে। হেমন্ত প্রযোজিত প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিস সাল বাদ’ একটা সময় সুপারহিট হয়। এরপর তিনি উত্তম কুমারকে দিয়ে হিন্দি সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি সেই সময় ‘শর্মিলি’ বলে একটি হিন্দি ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন, যার প্রধান চরিত্রে থাকার কথা ছিল মহানায়কের। এবং নায়িকার জন্য ঠিক ছিলেন ওয়াহিদা রেহমান। সব ঠিক থাক, শ্যুটিং এর জন্য টিম তৈরি, কিন্তু সেদিন উত্তম কমার অজ্ঞাত কারণে উপস্থিত হননি। পরবর্তীতে হেমন্তকে এর খেসারত দিতে হয় একক হস্তে। এরপরেই ‘উত্তম-হেমন্ত’ জুটির সাময়িক বিচ্ছেদ হয়।
পরবর্তীতে হেমন্ত বীরেন নাগের পরিচালনায় বিশ্বজিৎ ও ওয়াহিদাকে নিয়ে তৈরি করলেন ‘কোহরা’, সালটা তখন ১৯৬৪। যদি উত্তম কুমার ‘শর্মিলি’ ছবিতে অভিনয় করতেন তবে তাঁর জন্য আরেকটি হিন্দি ছবি ছিল, সেটি হল ‘সঙ্গম’। উনি শেষে একা ১৯৬৭ তে তৈরি করলেন ‘ছোটি সি মুলাকাত’। পরাজয় মেনেও বাংলায় রাজ করে গিয়েছিলেন তিনি। একের পর এক বাংলায় হিট সিনেমা উপহার দেওয়া মানুষটি শেষে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ দিয়ে বিদাই নিলেন। ২৪শে জুলাই ১৯৮০ সালে উত্তম কুমার মৃত্যুবরণ করেন। বয়স হয়েছিল তাঁর তখন মাত্র ৫৩। সেদিন তিনি ওগো বঁধু সুন্দরী সিনেমার শুটিং করছিলেন। ওই সেটেই হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর। বাংলার রাজ্যপাট রেখে বিদাই নেন।