বাংলার মিষ্টি হিসেবে আজও ঐতিহ্যবাহী জনাইয়ের মনোহরা, বিশেষ কারণেই এই মিষ্টির সৃষ্টি
পশ্চিমবঙ্গের অতি জনপ্রিয় মিষ্টি গুলির মধ্যে একটি অসাধারণ মিষ্টি হল মনোহরা। হুগলি জেলার জনাই এবং মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গার মনোহরা সবচেয়ে বিখ্যাত। তবে অনেক জায়গায় এই মিষ্টি আবার ‘চাউনি’ নামেও পরিচিত। মনোহরা হল ছানা ও চিনির অথবা সর ছাঁচি এবং ক্ষীরের মিশ্রণে গোল গোল আকারে মিষ্টি তার ওপরে চিনির স্তর দেওয়া এক প্রকার মিষ্টি। তবে পরবর্তীকালে কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকের গিরিশচন্দ্র দে, নকুড় চন্দ্র নন্দী চিনির বদলে নলেন গুড়ের প্রলেপ দেওয়া মনোহরা প্রচলন করেছিলেন।
মনোহরার ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, জনাইয়ের বিখ্যাত মনোহরার ইতিহাস প্রায় দু’শো বছরের উপর পুরনো। অনেকের মতে, ব্রিটিশ আমলে জনৈক এক ব্রিটিশ ব্যক্তি কলকাতা থেকে জনাই বেড়াতে যাচ্ছিলেন তখন ভীম চন্দ্র নাগ এদের বংশের একটি শাখা জনাই এর ষষ্ঠী তলায় বসবাস করতেন। সেই ব্যক্তি ওইখানকার ময়রাদের হুকুম করেছিলেন, যে তাদের এমন এক মিষ্টি তৈরি করতে হবে যা প্রায় টানা পাঁচদিন রেখে দিলেও কোনো রকম ভাবে নষ্ট হবে না। সেই সময় অত ফ্রিজের ব্যবহার ছিল না। তখন ভীম চন্দ্র নাগ এই বংশের শাখাটি বুদ্ধি খাটিয়ে এমন মিষ্টি বানানো জিনিসের উপরে পুরো চিনির আস্তরণ দিয়ে দিলেন যার ফলে মিষ্টি সহজে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারল না। অনায়াসে তিন থেকে পাঁচ দিন রেখে দেওয়া যায় বাইরে। আবার অনেকেই মনে করেন, মনোহরা এর আবিষ্কারক ভীম চন্দ্র নাগ এর পিতা পরান চন্দ্র নাগ। তিনি ছিলেন বর্ধমান রাজের দেওয়ান। তিনি তার সমস্ত চাকুরী ছেড়ে দিয়ে মিষ্টির ব্যবসাতেই মনোনিবেশ করেছিলেন। হুগলি জেলায় তিনি মিষ্টির ব্যবসা প্রথম শুরু করেন। এ সময় তিনি মনোহরা নামক মিষ্টি তৈরি করেছিলেন। আবার অন্য একদল মনে করেন, জনাইয়ের ময়রারা মিস্টি সংরক্ষণ করার জন্য নানান রকম পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিল। তখন তারা ভুলবশত এই চিনির রস এর মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেছিলেন সেই মিষ্টি। আবার অনেকেই মনে করেন, জনাইয়ের জমিদারবাড়ির জনৈক সদস্য স্থানীয় এক মহিলাকে সন্দেশ বানাতে দিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। আর সে নির্ধারিত সময়ের আগেই ফিরে এসেছিল। তখন সন্দেশ পুরোপুরি তৈরি হয়নি। হঠাৎ করে ফিরে আসার ফলে ময়রা তখন ভারে চিন্তায় পড়ে যান। তখন তিনি তাড়াতাড়ি সন্দেশ বানিয়ে গাঢ় চিনির রসে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তৈরি হয়েছিল মনোহরা। কারণ এই মিষ্টি খেয়ে জমিদার বাড়ির সেই সদস্য তৃপ্তি পেয়েছিলেন। মিষ্টি খেয়ে সেই মানুষটি এই মিষ্টির নাম রাখেন মনোহরা। আরেক মতে, ললিত ময়রা নামে এক ময়রা প্রথম মনোহরা উদ্ভাবন করেছিলেন।
জনাইয়ের মনোহরা নিয়ে যেমন নানা মুনির নানা মত, ঠিক তেমনই বেলডাঙ্গার মনোহরা নিয়েও একাধিক মতের প্রচলন রয়েছে। একটি মতানুসারে, মুর্শিদাবাদের নবাব অষ্টাদশ শতকে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ মিষ্টি। এই ময়রা এখন মুর্শিদাবাদ জেলার দহগ্রামের কাছে কিরীটকোনা গ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দির এর নিকট বাস করতেন। সেইখানেই প্রথম মনোহরা তৈরি হয়েছিল। বেলডাঙ্গার মনোহরার বিখ্যাত কারিগর ছিলেন নবনী সাহা। তার তৈরি প্রথম মনোহরা এক কালে খ্যাতির শিখরে উঠেছিল।
এই মিষ্টি তৈরি করতে লাগে ছানা, চিনি, পেস্তা, এলাচ, দুধ ইত্যাদি আবার অনেক সময় ডাবের শাঁস ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও মিহি করে চিনি এবং ছোট এলাচ ব্যবহার করা হয়। মিশ্রণ গুলি ভালো করে মিহি করে মেখে নেওয়া হয়। তারপরে ঠান্ডা হলে মন্ড প্রস্তুত করা হয়। মন্ড থেকে কিছুটা মিশ্রণ হাতের তালুতে নিয়ে গোল করে পাকানো হয়। তারপর সেই গোল গুলোকে পেস্তা ও এলাচের গুঁড়া সঙ্গে মাখানো হয়। অন্যদিকে চিনির রস জ্বাল দিয়ে সেই গোল করে পাকিয়ে রাখা মিষ্টি গুলি ফেলে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ ঘন চিনির রসে ফেলে দিলেই ওপরে শক্ত চিনির আস্তরণ পড়ে যায়।
পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার রসগোল্লা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের সীতাভোগ এর মত জনাইয়ের মনোহরাও বেশ বিখ্যাত। এর জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয়, এর জনপ্রিয়তা ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে ও পৌঁছে গেছে। জনাইয়ের মনোহরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি জায়গায় পাঠানো হয়। শুধু তাই নয়, স্বয়ং ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মনোহরা খুব ভক্ত ছিলেন। ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, ছায়া দেবী বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক নায়িকারা কলকাতা থেকে ফেরার সময় প্রায়ই গাড়ি থামিয়ে মনোহরা কিনতেন। তাহলে সব মিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে, কতটা প্রিয় মনোহরা। এক কামড়ে মন হরণ করার ক্ষমতা আছে মনোহরার, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।